দুই বছরের অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞ, রক্তপাত ও দুর্ভোগের পর অবশেষে আশার আলো দেখছে মধ্যপ্রাচ্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই সমঝোতা গাজায় মানবিক সহায়তার নতুন দরজা খুলে দিতে পারে, এবং দীর্ঘদিনের বন্দিত্বে থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির পথ প্রশস্ত করেছে।
দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর নতুন অধ্যায়
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সীমান্তপাড়ি হামলার পর শুরু হয় ইসরায়েলের ভয়াবহ সামরিক অভিযান। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে, যুক্ত করেছে ইরান, ইয়েমেন ও লেবাননের মতো দেশগুলোকেও। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাবে, এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ছাড়িয়েছে এবং অঞ্চলটির অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, হামাসের ওই আক্রমণে প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়েছিলেন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে এখনো ২০ জন জীবিত বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ
বুধবার মিশরে অনুষ্ঠিত পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি কাঠামোর প্রথম ধাপে পৌঁছেছে দুই পক্ষ। এই “প্রথম ধাপের শান্তি চুক্তি”তে উভয় পক্ষের স্বাক্ষরের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই তার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে।
তিনি লেখেন, “আমি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি: ইসরায়েল ও হামাস উভয়েই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে স্বাক্ষর করেছে। এর অর্থ হলো, সব জিম্মিকে শিগগিরই মুক্তি দেওয়া হবে, এবং ইসরায়েল সম্মত সীমারেখায় সেনা প্রত্যাহার করবে।”
ট্রাম্প আরও যোগ করেন, “এটি আরব ও মুসলিম বিশ্ব, ইসরায়েল, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক মহান দিন। আমরা কাতার, মিশর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের ধন্যবাদ জানাই, যাদের প্রচেষ্টায় এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি সম্ভব হয়েছে।”
মানবিক সহায়তার পথ খুলছে গাজায়
এই চুক্তির ফলে অবরুদ্ধ গাজায় অবিলম্বে মানবিক সহায়তা পাঠানোর পথ তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক খাদ্য পর্যবেক্ষক সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে তীব্র দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে।
ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি নিজে শিগগিরই মিশর সফরে যেতে পারেন এবং পরবর্তীতে ইসরায়েলেও যেতে পারেন বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যম Axios জানিয়েছে।
ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ঈশ্বরের কৃপায়, আমরা সব জিম্মিকে ঘরে ফিরিয়ে আনব।” তিনি বৃহস্পতিবার তার মন্ত্রিসভায় এই চুক্তি অনুমোদনের জন্য বৈঠক ডেকেছেন।
অন্যদিকে, হামাস জানিয়েছে, তারা যুদ্ধের অবসানে রাজি হয়েছে। চুক্তিতে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার ও বন্দি-বিনিময়ের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে সংগঠনটি ট্রাম্প ও গ্যারান্টর দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে।
কূটনৈতিক ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মিশরের, শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও তুরস্কের উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন, যা আলোচনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। ট্রাম্পের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন তার জামাতা জ্যারেড কুশনার ও দূত স্টিভ উইটকফ। ইসরায়েলি পক্ষ থেকে ছিলেন কৌশলবিষয়ক মন্ত্রী রন ডারমার, যিনি নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
বিশ্লেষণ: এক অনিশ্চিত শান্তির পথে
চুক্তিটি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির নতুন সম্ভাবনা তৈরি করলেও, এর সফল বাস্তবায়ন এখনো অনেক প্রশ্নের মুখে। অতীতের মতো এবারও যদি আস্থা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব দেখা দেয়, তবে এই যুদ্ধবিরতি টিকেও থাকতে না পারে।
তবে যদি এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় ধরনের পররাষ্ট্রনীতি সাফল্য হিসেবে গণ্য হবে—বিশেষ করে এমন সময়ে—যখন তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও সমাধান আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি এক নতুন আশার প্রতীক। গাজায় মানবিক ত্রাণ প্রবেশ, বন্দিদের মুক্তি এবং অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার যে সম্ভাবনা এই সমঝোতা তৈরি করেছে, তা এখন বিশ্বের নজরে। সময়ই বলবে, এই “ঐতিহাসিক দিন” আসলেই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির সূচনা করে কিনা।
#শান্তিচুক্তি #গাজা #ইসরায়েল_হামাস #ট্রাম্প #মধ্যপ্রাচ্য_সংঘাত #মানবিক_সহায়তা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট