দশকের পর দশক ধরে নিউইয়র্কের ফুটপাতগুলোতে কালো প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা আবর্জনা স্তূপ হয়ে থাকত। এসব ব্যাগই ইঁদুরদের জন্য হয়ে উঠেছিল “বাসস্থান প্রকল্প”। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ইঁদুর বিশেষজ্ঞ কেলি বায়ার্স বলেন, “আমি একসময় নিউইয়র্কে গবেষণার সময় ময়লার ব্যাগে লাথি মারলে ইঁদুরগুলো দৌড়ে বেরিয়ে যেত। যে কেউ এমন দেখলে জীবনের বাকি সময় ওই ব্লকে পা ফেলতে ভয় পাবে।”
২০২৩ সালে কীটনাশক কোম্পানি এমএমপিসি-র এক গবেষণায় দেখা যায়, শহরে ইঁদুরের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ, যা এক দশক আগের তুলনায় এক মিলিয়ন বেশি।
জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
এই ইঁদুর-সমস্যা শুধু ঘৃণার নয়, ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য হুমকিও বটে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইঁদুরের কারণে প্রতিবছর ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রামীণ অঞ্চলে তারা শস্য নষ্ট করলেও শহরে ক্ষতির ধরণ ভিন্ন। নগর ইঁদুর বিশেষজ্ঞ ববি করিগানের ভাষায়, “ইঁদুর প্রায় সারাক্ষণই প্রস্রাব ও মলত্যাগ করে।”
তারা ই-কোলাই, সালমোনেলা, টাইফাস ও লেপ্টোস্পাইরোসিসসহ ৫০টিরও বেশি রোগজীবাণু ছড়ায়, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
জলবায়ু পরিবর্তন ও ইঁদুর বৃদ্ধি
ভার্জিনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব রিচমন্ডের জীববিজ্ঞানী জোনাথন রিচার্ডসনের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৬টি শহরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও ইঁদুরের সংখ্যা বাড়ছে। মৃদু শীত ও খাবারের প্রাচুর্য তাদের প্রজনন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন হয়তো মেয়রদের নিয়ন্ত্রণে নয়, কিন্তু শহরে খাবারের উৎস বন্ধ করা সম্ভব। ১৯৬৮ সালের স্যানিটেশন ধর্মঘটের পর নিউইয়র্ক ধাতব ডাস্টবিন বাদ দিয়ে ভুলবশত প্লাস্টিক ব্যাগে আবর্জনা রাখার প্রথা শুরু করেছিল। এখন আবার তারা ফিরে যাচ্ছে ‘কনটেইনারাইজেশন’-এর পথে— অর্থাৎ ঢাকনাযুক্ত বিন ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুরের খাবার সরবরাহ বন্ধ করা।
নিউইয়র্কের নতুন নীতি: কনটেইনার বিপ্লব
২০২৩ সালের মে মাসে জেসিকা টিশের নেতৃত্বে শহর প্রশাসন একটি কঠোর ও তথ্যনির্ভর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প শুরু করে। বর্তমানে শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন— ছোট-বড় সব ধরনের বাসাবাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ— বাধ্যতামূলকভাবে ঢাকনাযুক্ত ইঁদুর-প্রতিরোধী বিন ব্যবহার করছে।
ওয়েস্ট হারলেমের হ্যামিলটন হাইটসে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা এই প্রকল্পে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে। এখন আরও বৃহৎ পরিসরে এই মডেলটি বিস্তারের পরিকল্পনা চলছে, যেখানে অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ ভবনকেও একই ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে।
এদিকে শহরের মাসিক ইঁদুর দেখার রিপোর্ট উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে— পরিকল্পনাটি কার্যকর হচ্ছে।
অন্যান্য শহরের তুলনামূলক চিত্র
যখন নিউইয়র্ক কিছুটা সাফল্য দেখাচ্ছে, তখনই ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইঁদুর সংক্রান্ত অভিযোগ ১৩ গুণ বেড়েছে। বোস্টনে দ্বিগুণ এবং টরন্টোতে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওয়াশিংটনে সমস্যা আরও বেড়েছে কারণ সেখানে সরকার নিজে ইঁদুর-প্রতিরোধী বিন সরবরাহ করে না বা বেসরকারি ঠিকাদারদের এমন বিন ব্যবহার বাধ্যতামূলকও করে না। ফলে অনেক বাসিন্দা সস্তা প্লাস্টিকের ডাস্টবিন ব্যবহার করছেন, যেগুলো ইঁদুর সহজেই ছিদ্র করে ফেলে। বোস্টনের কিছু এলাকায় এখনো সপ্তাহে চারদিন প্লাস্টিক ব্যাগে ময়লা রাস্তার পাশে রাখা হয়— যা ইঁদুরের স্বর্গরাজ্য তৈরি করে।
ভুল দিকের লড়াই
ড. বায়ার্সের মতে, “শহরগুলো আসলে সমস্যার ভুল অংশে মনোযোগ দিচ্ছে।” তাদের জোর trap বা rodenticide ব্যবহারে, যা শুধু ইঁদুরই নয়, অন্যান্য প্রাণীকেও মেরে ফেলতে পারে। শিকাগো এখন ইঁদুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় কাজ করছে। তবে বায়ার্স বলেন, “জন্মনিয়ন্ত্রণের চেয়ে খাবারের উৎস বন্ধ করাই বেশি ফলপ্রসূ— কারণ ইঁদুর যদি পাশে পিজার টুকরো পায়, তাহলে বিষে হাত দেবে কেন?”
প্রশাসনিক উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নিউইয়র্কে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ‘র্যাট জার’ নামে একজন কর্মকর্তা পুরো ইঁদুর দমন তদারকি করতেন, যদিও তিনি সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী–মানব মিথস্ক্রিয়া বিশেষজ্ঞ নিয়াম কুইন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরেই কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। ফলে ব্যবস্থাপনায় বিশাল ফাঁক তৈরি হয়।”
বোস্টনের মেয়র মিশেল উ জানিয়েছেন, “ইঁদুর এখন নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্বেগগুলোর একটি।” শহর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে শতাধিক রিমোট সেন্সর স্থাপন করেছে, যা ইঁদুরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। আগামী তিন বছরে শহরজুড়ে ময়লা সংগ্রহের হার বাড়ানো ও বিন ব্যবহারের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে তিনি বলেছেন, “প্রথমে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সবাই একই পৃষ্ঠায় আসে।”
নিউইয়র্ক প্রমাণ করেছে— সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিনির্ভর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিই ইঁদুরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। অন্য শহরগুলো যদি সময়মতো শিখে নেয়, তাহলে নগরজীবনের এই নীরব মহামারি একদিন হয়তো অতীত হয়ে যাবে।