চীনের শিল্পনীতি দেশটিকে দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নতির পথে এগিয়ে দিয়েছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন, রোবোটিক্স, এমনকি সেমিকন্ডাক্টর খাতেও দেশটি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর এক নতুন গবেষণা জানাচ্ছে—এই শিল্পনীতি যে বিপুল অর্থনৈতিক ব্যয় ও ক্ষতির বোঝা তৈরি করছে, তা পূর্বের ধারণার তুলনায় অনেক বেশি।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও নতুন পরিকল্পনা
চীন এখন বিশ্বের শীর্ষ বৈদ্যুতিক যান (EV) প্রস্তুতকারক, রোবট নির্মাণেও অগ্রগণ্য, এবং সেমিকন্ডাক্টর খাতে পিছিয়ে থাকলেও দ্রুত এগিয়ে আসছে। অক্টোবরের শেষভাগে কমিউনিস্ট পার্টির প্লেনাম বৈঠকে অর্থনৈতিক গতি ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধরে রাখার কৌশল নির্ধারণ হবে। ধারণা করা হচ্ছে, চীন ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরাশক্তি’ হয়ে ওঠার লক্ষ্য পুনরায় জোরদার করবে।
শিল্পনীতির ব্যাপকতা ও জটিলতা
‘মেড ইন চায়না ২০২৫’-এর মতো উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী আলোচিত হলেও চীনের সামগ্রিক শিল্পনীতি অনেকটাই অজানা থেকে গেছে। এর প্রধান কারণ—নীতি এত বেশি যে তার পরিমাণ বোঝাই কঠিন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হানমিং ফাংয়ের গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর সরকার যে এক লাখ নীতিদলিল প্রকাশ করে, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ কোনো না কোনোভাবে শিল্পনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
এ নীতিগুলো কখনও কেন্দ্রীয়, কখনও প্রাদেশিক বা নগর প্রশাসনের উদ্যোগে তৈরি হয়; ক্ষেত্রও ব্যাপক—অটোমোবাইল থেকে ওষুধ শিল্প পর্যন্ত। এসব নীতিতে ব্যবহৃত হয় নানা ধরনের প্রণোদনা—নগদ সহায়তা, কর ছাড়, স্বল্প সুদে ঋণ বা ছাড়কৃত দামে জমি বরাদ্দ।
আইএমএফ গবেষণার নতুন পরিসংখ্যান
আইএমএফ-এর তিন গবেষক—ড্যানিয়েল গার্সিয়া-মাসিয়া, সিদ্ধার্থ কোঠারি ও ইয়িফান তাও—সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এই চার ধরনের প্রণোদনার আর্থিক মূল্য নিরূপণ করেছেন।
তারা করপোরেট হিসাব, করছাড়ের পার্থক্য, ঋণের সুদের হার এবং জমির দামের ভিন্নতা বিশ্লেষণ করে ২০২৩ সালের জন্য হিসাব দেন: চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ৪.৪ শতাংশ এই শিল্পনীতিতে ব্যয় হয়েছে।
২০১১ সাল থেকে এ হার ৪–৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক–ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS)’–এর পূর্বানুমানের দ্বিগুণেরও বেশি। সিএসআইএস ২০১৯ সালে চীনের শিল্পনীতি ব্যয়কে জিডিপির মাত্র ১.৭ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া ব্যয় করেছিল ০.৭ শতাংশ, আর আমেরিকা মাত্র ০.৪ শতাংশ।
প্রণোদনার লক্ষ্য ও প্রভাব
নতুন গবেষণা বলছে, এই বিশাল অর্থ প্রধানত প্রযুক্তিনির্ভর খাতে যেমন সেমিকন্ডাক্টর ও হার্ডওয়্যার শিল্পে প্রবাহিত হচ্ছে, কৃষি বা নির্মাণ খাতে নয়। এটি চীনের সেই কৌশলেরই প্রতিফলন—যার মাধ্যমে তারা আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হতে চায়।
কিন্তু এই নীতির একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হলো সম্পদ বণ্টনে বিকৃতি। প্রণোদনা পাওয়া খাতগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন করছে, আর প্রতিরক্ষামূলক নীতিতে থাকা খাতগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে সামগ্রিক উৎপাদন দক্ষতা কমে যাচ্ছে।
উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
গবেষণা অনুযায়ী, এ ধরনের বিকৃতির কারণে চীনের ‘মোট উৎপাদন উপাদান দক্ষতা’ (Total Factor Productivity) বর্তমানে যা হওয়া উচিত ছিল, তার চেয়ে ১.২ শতাংশ কম। ফলস্বরূপ, জিডিপি প্রতিবছর প্রায় ২ শতাংশ কমে যাচ্ছে—যার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়, এই প্রণোদনানির্ভর খাতগুলোতেও উৎপাদনশীলতা বাড়েনি। বরং সেখানে ‘অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা’ বা তথাকথিত ‘অন্তঃসংকোচন’ (involution) দেখা দিয়েছে—যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সঙ্গে নিরর্থক দৌড়ে যুক্ত হচ্ছে, যেমন বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতাদের মধ্যে মারাত্মক দামের প্রতিযোগিতা।
অর্থনৈতিক আত্মতুষ্টি ও ভবিষ্যৎ উদ্বেগ
চীনের নীতিনির্ধারকেরা এই বিপুল ক্ষতির হিসাব নিয়ে হয়তো খুব বেশি উদ্বিগ্ন নন। তাদের চোখে প্রযুক্তিনেতৃত্ব এবং স্বনির্ভরতা জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন। কিন্তু বাস্তবে এর মাশুল ভারী। অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে গত তিন বছর ধরে চীনে ‘কারখানার দরজামূল্য’ বা পাইকারি শিল্পমূল্য ক্রমাগত কমছে।
আসন্ন প্লেনাম বৈঠকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—নীতিনির্ধারকেরা কি তাদের শিল্পনীতির প্রকৃত মূল্য ও ব্যয় বুঝতে পারছেন, নাকি শুধুই ‘শক্তিধর প্রযুক্তি জাতি’ হওয়ার স্বপ্নেই আবদ্ধ থাকছেন?
চীনের শিল্পনীতি নিঃসন্দেহে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু IMF-এর বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে, এই ইঞ্জিন চালাতে যে জ্বালানি খরচ হচ্ছে, তার দাম শুধু অর্থনৈতিক নয়—উৎপাদনশীলতার ক্ষতি, মূল্যহ্রাস ও বৈশ্বিক বাজার বিকৃতিও এর অংশ। ২০৩০ সালের লক্ষ্য পূরণে চীনকে তাই শুধু ‘আরও ব্যয়’ নয়, ‘আরও দক্ষতা’র পথ খুঁজতে হবে।