জাভিয়ের মিলে’র সংস্কার পরিকল্পনা ঝুঁকিতে: টিকে থাকতে দরকার অর্থনৈতিক স্থিতি ও রাজনৈতিক সাফল্য
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলে এখন এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। দেশের মুদ্রা ‘পেসো’র পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির অভিযোগ এবং জনঅসন্তোষ—সব মিলিয়ে তাঁর অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা এখন গভীর সংকটে।
ক্ষমতায় আসার সময় যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা এখন কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করছে।
রকস্টার রাজনীতি: জনসমর্থন ফেরানোর চেষ্টা
৬ অক্টোবর বুয়েনস আইরেসের এক স্টেডিয়ামে মিলে চামড়ার লম্বা কোট পরে হাজির হন—একজন রকস্টারের মতো। জনপ্রিয় আর্জেন্টাইন রক গানের সঙ্গে নেচে তিনি জনগণের সামনে আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণবন্ত নেতৃত্বের চিত্র তুলে ধরতে চান। উদ্দেশ্য ছিল, আসন্ন ২৬ অক্টোবরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের উদ্দীপ্ত করা। তবে সমালোচকেরা বলছেন, এই নাটকীয়তা হয়তো বাস্তব অর্থনৈতিক সংকট ঢাকতে পারবে না।
মার্কিন প্রতিশ্রুতিতে সাময়িক স্বস্তি
২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ঘোষণা দেন—“আর্জেন্টিনার মুদ্রা স্থিতিশীল রাখতে যা কিছু প্রয়োজন, আমরা তা করব।” এ সময় আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র দুই দিনে ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে পেসো’কে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।
বেসেন্টের বক্তব্যে বাজারে সাময়িক স্থিতি এলেও বাস্তব সহায়তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এখনো দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান নেতারাও এই সম্ভাব্য বেইলআউট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখনো নড়বড়ে।
ডলারের ওপর নির্ভরতা ও মুদ্রার দোলাচল
প্রতিবার মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট কোনো মন্তব্য করলেই আর্জেন্টিনার মুদ্রা ও বন্ডের দামে ব্যাপক ওঠানামা হয়। গত ছয় দিনে দেশটি মুদ্রা স্থিতিশীল রাখতে ২ বিলিয়নেরও বেশি ডলার বিক্রি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে মিলে’র অর্থনৈতিক দল ওয়াশিংটনে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহায়তা চুক্তি করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু মার্কিন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আর্জেন্টিনার নিজস্ব সংসদীয় ভারসাম্য—দুটিই এখন এই পরিকল্পনাকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
নির্বাচনের আগে ভয়: সংস্কার থেমে যাওয়ার আশঙ্কা
যদি আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে মিলে’র দল বড় ধরনের পরাজয়ের মুখে পড়ে, তাহলে তাঁর কঠোর অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা কার্যত থেমে যাবে। জনগণ এখন মুদ্রাস্ফীতি নয়, বরং দুর্নীতি, চাকরি হারানো ও জীবিকার অনিশ্চয়তা নিয়ে বেশি চিন্তিত।
২৬ অক্টোবর পর্যন্ত মিলে’র জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—পেসো’কে স্থিতিশীল রাখা এবং সংসদে যথেষ্ট আসন নিশ্চিত করা, যাতে সংস্কার পরিকল্পনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
৮ বিলিয়ন ডলারের বাজি: ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ
স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইনভেক কনসালট্যান্সির হিসেবে, নির্বাচনের আগে বাজারে স্থিতি আনতে সরকারকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে হতে পারে।
এই বিপুল ব্যয় বিদেশি ঋণদাতাদের উদ্বিগ্ন করছে, কারণ তারা চায় সরকার ভবিষ্যতের জন্য ডলার মজুত রাখুক। ফলে সরকার হয়তো ভোটের আগে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নতুন সীমাবদ্ধতা আনতে পারে।
মিলে আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সরাসরি আর্থিক নিশ্চয়তা পেলে এ ধরনের সীমাবদ্ধতা প্রয়োজন হবে না। তবে বাজারের সুর এখন একটাই—“প্রতিশ্রুতি নয়, টাকাটা দেখান।”
দুর্নীতির অভিযোগে নৈতিক সংকট
২০২৩ সালে ক্ষমতায় এসে মিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে “লা কাস্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এখন তিনটি বড় দুর্নীতির ঘটনায় তাঁর সরকার চাপে।
প্রথমত, তিনি এমন এক ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রকল্প সমর্থন করেছিলেন যার মূল্য পরে ধসে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, আগস্ট মাসে ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপে অভিযোগ ওঠে—তাঁর বোন রাষ্ট্রীয় ওষুধ কেনাকাটা থেকে কমিশন নিচ্ছিলেন।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে ৫ অক্টোবর, যখন দলের শীর্ষ প্রার্থী হোসে লুইস এসপার্ট স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান। পরে জানা যায়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারের মামলায় অভিযুক্ত এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ লাখ ডলার নিয়েছিলেন, যদিও দাবি করেন এটি ছিল বৈধ পরামর্শ ফি।
অর্থনীতি থেকে জনগণের নজর সরছে
মিলে’র প্রথম দিকের জনপ্রিয়তা এসেছিল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে তাঁর নীতি একসময় প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এখন জনগণের মূল উদ্বেগ দুর্নীতি ও কর্মসংস্থান।
পেসো কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী রাখার ফলে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলেও বিনিয়োগ ও চাকরির বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে জনমনে বাড়ছে হতাশা ও অনিশ্চয়তা।
রকস্টাইল রাজনীতি যথেষ্ট নয়
সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, মিলে’র দল এখনো কিছুটা জনসমর্থন ধরে রেখেছে, কিন্তু গতি তাঁদের বিপক্ষে। মুদ্রা সংকট, দুর্নীতির অভিযোগ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মিলে প্রেসিডেন্টের সামনে এক কঠিন সময় এনে দিয়েছে।
এই অবস্থায় রক কনসার্ট বা প্রচারণার নাটক নয়—বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক পদক্ষেপই হতে পারে তাঁর একমাত্র ভরসা।
#আর্জেন্টিনা #জাভিয়ের_মিলে #অর্থনীতি #মুদ্রাসঙ্কট #দুর্নীতি #নির্বাচন #সারাক্ষণ_রিপোর্ট