রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে উড়ছে চীনের খনিশিল্প
চীনের রেয়ার-আর্থ (দুর্লভ খনিজ) রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে দেশটির খনিশিল্পে লাভ ও শেয়ারের দাম দুটোই বেড়েছে। এই খনিজগুলোর চাহিদা ও দাম বাড়ার ফলে খনি কোম্পানিগুলো নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
চীনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘শেংহে রিসোর্সেস হোল্ডিং’ জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে তাদের মুনাফা ৭৪০ মিলিয়ন থেকে ৮২০ মিলিয়ন ইউয়ানের (প্রায় ১০৪ থেকে ১১৫ মিলিয়ন ডলার) মধ্যে থাকবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭৮৩ শতাংশ বেশি। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড জানিয়েছে, “বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার কাঠামো বদলে গেছে, যার ফলে মূল পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দামও বেড়েছে।”
নতুন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হুমকি
এপ্রিল থেকে খনিজের দাম বেড়েছে, যখন চীন সাতটি গুরুত্বপূর্ণ রেয়ার-আর্থ খনিজ—স্যামেরিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টার্বিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, লুটেটিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম—এর রপ্তানি সীমিত করে। এগুলো ব্যবহৃত হয় স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি, বায়ুবিদ্যুৎ টারবাইন, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কৌশলগত শিল্পে।
সম্প্রতি চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও পাঁচটি রেয়ার-আর্থ খনিজকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের তালিকায় যুক্ত করেছে। সেই সঙ্গে পরিশোধন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হবে, যা কার্যকর হবে আগামী ৮ নভেম্বর থেকে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ১ নভেম্বর থেকে চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে, যা আগের ৩০ শতাংশের সঙ্গে যুক্ত হবে।
রেয়ার-আর্থ কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে উত্থান
এই ঘোষণার পর চীনের খনিজ কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্য এক লাফে বেড়ে যায়।
- • চায়না রেয়ার আর্থ রিসোর্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি-র শেয়ার মঙ্গলবার ৬৬ ইউয়ান ছুঁয়ে সর্বকালের সর্বোচ্চে পৌঁছায়। কোম্পানিটি এ বছরের প্রথমার্ধে ১৬১.৭০ মিলিয়ন ইউয়ান লাভ করেছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে ২৪৪.৪১ মিলিয়ন ইউয়ান ক্ষতি হয়েছিল।
- • চায়না নর্দার্ন রেয়ার আর্থ (গ্রুপ) হাই-টেক — দেশটির সবচেয়ে বড় রেয়ার-আর্থ খনি কোম্পানি, জানিয়েছে যে জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে তাদের নিট মুনাফা ১.৫১ বিলিয়ন থেকে ১.৫৭ বিলিয়ন ইউয়ানের মধ্যে থাকবে—যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৮৭ শতাংশ বেশি।
- • শিয়ামেন টাংস্টেন কোম্পানির শেয়ার মঙ্গলবার ৩৪.৪১ ইউয়ানে পৌঁছে সেপ্টেম্বর ২০২১-এর উচ্চতা অতিক্রম করে।
- • রাইজিং ননফেরাস মেটালস, যা চায়না রেয়ার আর্থ গ্রুপের অধীনস্থ, তাদের শেয়ারও ৬৭.৯৮ ইউয়ানে উঠে যায়, যা চার বছর আগের সর্বোচ্চ ৭৩.৮৮ ইউয়ানের কাছাকাছি।
শেংহে রিসোর্সেসের শেয়ার ২৭.৩৭ ইউয়ানে উঠে সেপ্টেম্বর ২০২১-এর সর্বোচ্চ ২৯.২৮ ইউয়ানের কাছাকাছি পৌঁছায়। বুধবার সামান্য পতন হলেও শেংহের শেয়ার উল্টো ৫ শতাংশ বেড়েছে।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় কূটনৈতিক কৌশল
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রেয়ার-আর্থ রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক—উভয় সিদ্ধান্তই কৌশলগত আলোচনায় প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।
ইউনিয়ন ব্যাংক প্রিভে’র এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্লোস কাসানোভা বলেন, “দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংজুতে এ মাসের শেষে অনুষ্ঠিতব্য এপেক সম্মেলনের আগে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার চাপ বাড়াতে এই কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি সমালোচনা করে বলেন, “চীন সর্বদা সংলাপ বজায় রেখেছে এবং সোমবার দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে কার্যকরী আলোচনা হয়েছে।”
তবে ন্যাটিক্সিস ব্যাংকের প্রধান এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনীতিবিদ আলিশিয়া গার্সিয়া হেরেরো সতর্ক করে বলেন, “এই নতুন বাণিজ্যিক উত্তেজনা দুটি দেশের মধ্যে অবিশ্বাস আরও গভীর করেছে এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলার বিভাজনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র রেয়ার-আর্থ উপাদানের ঘাটতি মোকাবিলায় বিকল্প উৎসে বিনিয়োগ এবং নিজস্ব পরিশোধন সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে জোর দেবে।”
রেয়ার-আর্থ খনিজের বাজারে চীনের নিয়ন্ত্রণ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া নতুন এক অর্থনৈতিক সংঘাতের সূচনা করেছে। এতে একদিকে চীনের খনিশিল্প লাভবান হচ্ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প জোগান গড়ে তুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুই পরাশক্তির এই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
# চীন, যুক্তরাষ্ট্র, বাণিজ্যযুদ্ধ, রেয়ার-আর্থ, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, শেয়ারবাজার, খনিজশিল্প, এপেক সম্মেলন, অর্থনৈতিক নীতি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট