ইউরোপ অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা ও বহিরাগত ভূরাজনৈতিক চাপের মুখে এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা একত্রে মহাদেশটিকে একটি ভঙ্গুর ভূখণ্ডে পরিণত করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ইউরোপকে এখন সমন্বিতভাবেই পুনর্গঠনের পথে এগোতে হবে।
ইউরোপ এক গভীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশলগত অস্পষ্টতার ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে, নির্ভরশীলতার অজুহাতও আর কাজ করছে না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও বহিরাগত ভূরাজনৈতিক চাপ মিলে ইউরোপকে দুর্বল, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত করার হুমকি তৈরি করেছে। সার্বভৌমত্ব ইতিহাসের অধিকারের বিষয় নয়—এটি এমন এক সক্ষমতা, যা নিয়মিত বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা এবং রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে বজায় রাখতে হয়।
এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে ইউরোপকে তিনটি ক্ষেত্রে—রাজস্বক্ষমতা, সামরিক প্রতিরোধক্ষমতা এবং রাজনৈতিক বৈধতা—সমন্বিত পুনর্গঠন করতে হবে। প্রশ্ন এখন আর ‘ইউরোপ সার্বভৌমত্ব চায় কিনা’ নয়; বরং ‘সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠানগত রূপান্তর ও ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে ইউরোপ প্রস্তুত কি না।’
রাজস্ব সার্বভৌমত্ব: অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটানোর কৌশল
রাজস্ব সার্বভৌমত্ব অর্জনের অর্থ হলো উচ্চ কল্যাণব্যয় ও ঋণসেবার বোঝা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অর্থ সরানো। বাইরের পুঁজি ও সরবরাহব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমানো অপরিহার্য।

একটি কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সার্বভৌম তহবিল গঠন হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর উপায়—যা শুধু অনুদান বণ্টন নয়, বরং শিল্পে সরাসরি ইকুইটি বিনিয়োগকারী কৌশলগত সম্পদ তহবিল হিসেবে কাজ করবে। সবুজ ও ডিজিটাল রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ইউরোপ তার শিল্পনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে পারবে।
ক্রিটিক্যাল র-ম্যাটেরিয়ালসে চীনের আধিপত্য ইউরোপের জন্য বড় ঝুঁকি। গ্রাফাইট প্রক্রিয়াকরণে চীনের দখল ৮৫ শতাংশ, অ্যান্টিমনিতে ৯২ শতাংশ। ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতারা ব্যাটারির মূল উপাদান লিথিয়াম যৌগের ৭৫ শতাংশই চীনা শোধনাগারে নির্ভর করে। শুধু নতুন খনি খুললেই এই দুর্বলতা দূর হবে না।
চিপস অ্যাক্ট ও ক্রিটিক্যাল র-ম্যাটেরিয়ালস অথরিটির মতো নীতি বাজারের ওপর নির্ভরতা ছেড়ে রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন কৌশলগত শিল্পনীতির দিকে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। মূল লক্ষ্য—প্রয়োজনীয় সরবরাহচক্রের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন।
ন্যাটো-নির্ভরতা পেরিয়ে নিজস্ব প্রতিরক্ষা
ইউরোপের সামরিক সার্বভৌমত্ব মানে এমন প্রতিরোধশক্তি গড়ে তোলা, যা মার্কিন অনিশ্চয়তার সময়ও নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। ২০২৪ সালে ইইউ প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ১.৯ শতাংশ; কার্যকর প্রতিরোধের জন্য অতিরিক্ত ১.৪ শতাংশ জিডিপি প্রয়োজন। সমস্যা অর্থায়ন নয়, বরং রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা।
পেসকোর আন্তঃসরকারি কাঠামো এবং ইউরোপীয় ডিফেন্স ফান্ডের অতিঃরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দ্বন্দ্বে সমন্বিত প্রতিরক্ষা বাজার গড়ে উঠছে না। এর সমাধানে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার—সম্ভবত একটি নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি—অপরিহার্য।
একত্রীকৃত কমান্ড কাঠামো, সমন্বিত অস্ত্র রপ্তানি নীতি এবং অভিন্ন প্রতিরক্ষা শিল্প সামরিক সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হতে পারে। পূর্ব ইউরোপ—বিশেষত পোল্যান্ডের ৪.৭ শতাংশ জিডিপি প্রতিরক্ষা ব্যয়—ইউরোপের নতুন নিরাপত্তা অক্ষ তৈরি করেছে। এই সক্ষমতাকে পশ্চিম ইউরোপের প্রযুক্তি ও আর্থিক শক্তির সঙ্গে একীভূত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব: ইউরোপের গণতান্ত্রিক সংকট
ইউরোপের সবচেয়ে বড় সংকট রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে। ঋণ সংকটের পর ইউরোজোনের নীতি-প্রক্রিয়া ‘গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ঘাটতি’ তৈরি করেছে বলে ধারণা জোরদার হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ও ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান সেই ক্ষোভকে আরও তীব্র করেছে।
বিতর্কের কেন্দ্রে এখন ‘সার্বভৌমত্ব’—ইউরোপীয় সার্বভৌমত্ব বনাম জাতীয় সার্বভৌমত্ব। এই দ্বন্দ্ব সমাধানে দরকার নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করে পুরনো কর্তৃত্ব ধারণা ছেড়ে বেরিয়ে আসা।
ইউরোপকে তার পরিচয় নতুনভাবে নির্ধারণ করতে হবে—শুধু বাজার হিসেবে নয়, বরং একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে। সর্বসম্মতির শর্ত বড় সিদ্ধান্তকে আটকে রাখছে। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোট চালু করা—ঝুঁকিপূর্ণ হলেও জরুরি। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণই সার্বভৌমত্ব অর্জনের মূল চাবিকাঠি।

ইউরোপের সামনে সম্ভাব্য তিনটি ভবিষ্যৎ পথ
১. মহাদেশীয় নির্ভরতা
ইউরোপ ঋণ সংকট ও সামরিক বিভাজন কাটাতে ব্যর্থ হয়; যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। উদ্ভাবন ও দক্ষ মানবসম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। ইউরোপ শক্তিহীন অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হয়।
২. পূর্বাঞ্চলীয় ফেডারেশন
পূর্ব ইউরোপ—বিশেষত B9 ও 3SI ব্লক—উচ্চ প্রতিরক্ষা ব্যয় ও স্পষ্ট ভূরাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নতুন শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ন্যাটোর নিরাপত্তা কাঠামোর কেন্দ্র পূর্বে সরে যায়। ফ্রান্স–জার্মানির নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যদি তারা এই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য না আনে।
৩. ভঙ্গুর ইউরোপ
রাজনৈতিক অচলাবস্থা গভীর হয়। দেশগুলো জাতীয় স্বার্থে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পুঁজি, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের প্রবাহ ভেঙে যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। ইউরোপ বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অস্থির ময়দানে পরিণত হয়।
ইউরোপের অশ্রুত ভবিষ্যৎ
২১শ শতাব্দীর ইউরোপ এখনো তার পথ নির্ধারণ করেনি। সার্বভৌমত্ব অর্জনের রূপরেখা স্পষ্ট হলেও তা রাজনৈতিকভাবে কঠিন। ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী যুগের ভুল অগ্রাধিকার বদলে কৌশলগত বিনিয়োগে অগ্রসর হওয়া, বিচ্ছিন্ন প্রতিরক্ষা থেকে একীভূত কাঠামোয় রূপান্তর এবং প্রক্রিয়ার চেয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এখন জরুরি।
সার্বভৌমত্ব ধার করা যায় না—না যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে, না চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে। ইউরোপকে নিজস্ব বিনিয়োগ, সামরিক সংহতি এবং রাজনৈতিক সাহসের ভিত্তিতে নিজের সার্বভৌমত্ব গড়তে হবে। তা না হলে অন্যেরা ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে—প্রতিদ্বন্দ্বীরা, এমনকি দুর্বল হয়ে পড়া মিত্ররাও।
#tags: ইউরোপ_সার্বভৌমত্ব ইউরোপ_রাজনীতি ভূরাজনীতি সামরিক_কৌশল ইইউ_সংকট অর্থনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















