ফকির লালন শাহের ১৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতীয় হাইকমিশন ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৬ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘লালন সন্ধ্যা’ শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে লালনগীতির সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন (১৯৫৪–২০২৪)-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। উদ্বোধনী বক্তৃতায় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ভারত–বাংলাদেশের অভিন্ন মানবতাবাদী ঐতিহ্য ও লালনের অন্তর্ভুক্তির দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠান ও উদ্দেশ্য
আয়োজনটির লক্ষ্য ছিল ফকির লালন শাহ—মানবতাবাদী সাধক, দার্শনিক ও কবি—এর চিরন্তন দর্শন স্মরণ ও ধারণ করা। কুষ্টিয়ায় জন্ম নেওয়া লালনের গান ও ভাবনা ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার—ধর্মীয় সম্প্রীতি, বর্ণ–শ্রেণির ঊর্ধ্বে মানবিক ঐক্য এবং ভক্তি–সুফি–ফকির ধারার মিলিত মানবধর্ম—কে দৃঢ় করে। তাঁর গান মানুষকে শান্তি, সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তির মূল্যবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়।
ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা
লালনগীতি জনপ্রিয়করণে ফরিদা পারভীনের অবদান অনন্য। একুশে পদক (১৯৮৭) ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯)সহ বহু স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই শিল্পীর কণ্ঠে লালনের দর্শন বিশ্বজুড়ে নতুন পাঠক–শ্রোতার কাছে পৌঁছেছে। ‘লালন সন্ধ্যা’য় তাঁর স্মৃতির প্রতি বিশেষ সঙ্গীতাঞ্জলি নিবেদন করা হয়।

উদ্বোধনী মন্তব্য: ভারত–বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ
উদ্বোধনী বক্তৃতায় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা দুই দেশের দীর্ঘদিনের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, লালনের অন্তর্ভুক্তি, সামঞ্জস্য, করুণা ও মানবতার দর্শন জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে আজও সমান প্রাসঙ্গিক; এই অভিন্ন ঐতিহ্য ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ যাত্রাকে উদ্বুদ্ধ করে। ফরিদা পারভীনের শিল্পীসত্তাকে তিনি প্রজন্ম–ও–দেশের সেতুবন্ধ হিসেবে তুলে ধরেন এবং জানান—এ আয়োজন শুধুই স্মরণ নয়, যৌথ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উদ্যাপনও।
শ্রদ্ধাঞ্জলির ধারাবাহিকতা
ফরিদা পারভীনকে ঘিরে পর্ব শুরু হয় তাঁর গান দিয়ে—যার মধ্যে ছিল ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবের অনূদিত হিন্দি সংস্করণগুলোর উপস্থাপনা। বাঁশিতে সুর তোলেন তাঁর স্বামী ও একুশে পদকপ্রাপ্ত গাজী আবদুল হাকিম। শিষ্যা বিউটির একক পরিবেশনা এবং ‘ওসিন পাখি কালচারাল একাডেমি’র শিক্ষার্থীদের কোরাস—সব মিলিয়ে শ্রোতারা শিল্পীর স্মৃতি ও উত্তরাধিকারকে নতুন করে অনুভব করেন।
সংস্কৃতি পর্ব: ঐতিহ্য ও সমসাময়িকতার সুর
চন্দনা মজুমদার ও কিরণ চন্দ্র রায়ের একক পরিবেশনায় সমকালীন বাংলাদেশে লালনের ধারা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর মেলে। কুষ্টিয়া থেকে আসা টুনটুন বাউল ও তাঁর দল আসল বাউল–সুরে মুগ্ধতা ছড়ান। ‘লালন বিশ্ব সংঘ’-এর প্রবন্ধকার আবদেল মান্নান লালনের জীবন, শিক্ষা, দর্শন ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বক্তব্য দেন। সমাপনীতে সুমির নেতৃত্বে ব্যান্ড ‘লালন’ আধুনিক সংগীতভাষায় লালনের বাণীকে নবপ্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। পুরো আয়োজন উপস্থাপনা করেন খ্যাতিমান অভিনেতা আফজাল হোসেন, যিনি সন্ধ্যার বিভিন্ন পর্বে লালনের জীবন ও দর্শনের সঙ্গে সংযোগ রচনা করেন।

কেন আজও প্রাসঙ্গিক
লালনের গান ও কথা বিভাজন নয়, মিলনের কথা বলে। সামাজিক বৈষম্য, সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতার সময়ে তাঁর ‘মানবধর্ম’—সহনশীলতা, সাম্য ও সহমর্মিতার বার্তা—দুই দেশের তরুণ সমাজকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। ফরিদা পারভীনের শিল্পকীর্তি সেই বাণীকে দীর্ঘদিন ধরে শুদ্ধ সুরে বহন করেছে।
‘লালন সন্ধ্যা’ ছিল ফকির লালন শাহ ও ফরিদা পারভীনের প্রতি হৃদয়ের উৎসর্গ, পাশাপাশি বাংলাদেশ–ভারতের সাংস্কৃতিক সংযোগের আন্তরিক উদ্যাপন। ভাষা, সংগীত, দর্শন ও ঐতিহ্যের ঐক্যবোধে এই আয়োজন দুই দেশের অভিন্ন মূল্যবোধ—শান্তি, সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তি—আরও সুদৃঢ় করে।
#লালন_শাহ #লালন_সন্ধ্যা #প্রণয়_ভার্মা #ভারতীয়_হাইকমিশন #ইন্দিরা_গান্ধী_সাংস্কৃতিক_কেন্দ্র #মুক্তিযুদ্ধ_জাদুঘর #ফরিদা_পারভীন #বাউল_সংস্কৃতি #বাংলাদেশ_ভারত_সম্পর্ক #সাংস্কৃতিক_অনুষ্ঠান
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















