বোয়ালিয়ায় বিদ্যা শিক্ষার সময় যোগেন্দ্রনারায়ণ সমপাঠীদের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাতেই তাহার সুশীলতা, উদারতা ও মহত্ত্বের পরিচয় লেখক স্বয়ং পাইয়া কৃতার্থ মনে করিয়াছিল। তাহার সাহস ও নির্ভীকতা নিতান্ত প্রশংসনীয়। কোন অপরিচিত ভদ্রলোক তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলে তাহার প্রতি তিনি যেরূপ সৌজন্য ও নম্রতা দেখাইতেন, তাহাতে সেই ভদ্রলোক যথেষ্ট প্রীতি লাভ করিতেন। পরের দুঃখ মোচনে তিনি নিতান্ত ব্যগ্র হইতেন। তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং কার্যে বীরের ন্যায় ছিলেন। যাহা প্রতিজ্ঞা করিতেন তাহা পালন জন্য নিজ প্রাণ পর্যন্ত পণ করিতেন। বিষয় কার্যে তাহার বুদ্ধি অধিক ছিল। “প্রজারা আমার প্রাণাপেক্ষা সহোদর ভ্রাতা।”২৭-এই বাক্যের প্রত্যেক কথায়, প্রত্যেক অক্ষরে, তাহার মহৎ চরিত্রের এরূপ প্রমাণ যে, তাহাকে সুরাপান দোষে কলঙ্কিত করা আমাদের উচিত নহে। যাহার গুণের ভাগই বেশি এবং যাহার কেবলমাত্র একটি দোষ, তাহাকে রাজাদের মধ্যে উচ্চ আসন অনায়াসে দেওয়া যাইতে পারিত; কিন্তু শয়নে ও ভোজনে অপরিমিতাচার দোষ আশ্রয় করিয়া ঐশ্বরিক নিয়ম লঙ্ঘন করার জন্য তাহাকে আমরা উচ্চ আসন দিতে কুণ্ঠিত হইলাম। জীবনকে রক্ষা করিয়া মানবের ধর্ম, অর্থ, কাম- সকলই উপার্জন করা উচিত। তিনি দীর্ঘজীবী হইলে, প্রজারা তাহাকে যে পিতা অপেক্ষা বেশি ভক্তি করিত তাহার আর কোন, সন্দেহ নাই। তিনি কেবল ২/৩ বৎসর মাত্র রাজত্ব করিয়াছিলেন। এই অল্পকাল মধ্যেই প্রজারা তাহাকে ভয় না করিয়া ভক্তি করিত। ইহা রাজার চরিত্রের একটি মহাগুণ। মোটের উপর বলিতে যোগেন্দ্রনারায়ণ “দাতা, সত্যপ্রতিজ্ঞ, পরোপকারী, বুদ্ধিমান, স্বাধীনচেতা ২৮, কিন্তু অপরিমিতাচারী। তিনি প্রজা-হিতৈষী ছিলেন। তাহার অভাবে লস্করপুর পরগণার প্রজারা পিতৃহীন হইয়া বহুতর শোক প্রকাশ করিয়াছে।
যোগেন্দ্রনারায়ণ মৃত্যুর সময় তাহার ত্রয়োদশ বৎসর বয়স্কা পত্নীর হস্তে যাবতীয় সম্পত্তির ভার ন্যস্ত করিয়া দেন এবং ইহাতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে রাণী শরৎসুন্দরীর গুণের পরিচয় পাইয়া তাহাকে বিস্তৃত রাজ্য শাসনের উপযুক্ত পাত্রী জ্ঞান করিয়াছিলেন। রাজসাহীর কালেক্টর মিঃ ওয়েলস সাহেবের রিপোর্ট অনুসারে বাংলা ১২৭২ সালে প্রায় ১৫ বৎসর বয়সে শরৎসুন্দরী কোর্ট অব ওয়ার্ডস হইতে যাবতীয় সম্পত্তির ভার গ্রহণ করেন। তদপর বাংলা ১২৭৩ সালের মাঘ মাসে শরৎসুন্দরী দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন। তিনি এই উপলক্ষে ব্রাহ্মণ ও দীন-দুঃখীকে বিস্তর দানাদি করিয়াছিলেন। দত্তকের নাম রাখিলেন, যতীন্দ্রনারায়ণ। ১২৮১ সালের মাঘ মাসে দত্তকের উপনয়ন এবং বাংলা ১২৮৭ সালের ফাল্গুন মাসে বিবাহ হয়। দত্তকের পত্নীর নাম হেমন্তকুমারী দেবী। উপনয়ন ও বিবাহ উপলক্ষেও “সংস্কৃত শাস্ত্র ব্যবসায়ী পণ্ডিতদিগের ও দীন দুঃখীর সাহায্যার্থ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়িত হইয়াছিল। ২৯ শরৎসুন্দরীর জীবন বৃত্তান্ত বিস্তারিতরূপে লিখিতে গেলে স্বতন্ত্র আর একটি গ্রন্থাকার ধারণ করিবে তাহার আর সন্দেহ নাই। “কুলশাস্ত্র দীপিকা” গ্রন্থে এবং “বঙ্গবাসী” সংবাদপত্রে মহারাণী শরৎসুন্দরী সম্বন্ধে যে যে কথা লিখিত হইয়াছে, তাহা উদ্ধৃত করিয়া দিলেই তাহার জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং তাহার গুণরাশির কীর্তন করা হইবে। তাহার গুণ এত বেশি যে সহস্র মুখে বহুকাল কীর্তন করিলেও তারা শেষ হইবার নহে। সুতরাং উদ্ধৃত অংশ ব্যতীত আরো কিছু বলিবার আশা রহিল।
“রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ লোকান্তরিত হইলে তৎপত্নী শ্রীমতী মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবী রাজ্যাধিকার লাভ করেন। ইনিও তৎকালে অল্প বয়স্কা ছিলেন। দেবের প্রতিকূলে বিধির বিপাকে এই পুণ্যশীলা ও প্রাতঃস্মরণীয়া রমণীকে অকালে জীবনের প্রথম ভাগেই নিদারুণ বৈধব্য দশায় নিপতিত হইতে হইল। ইনি স্বীয় মহামূল্যবান জীবনকে তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানে নিয়ত ধর্ম কার্যে, দেব সেবায় এবং তীর্থ পর্যটনে সময়াতিবাহিত করিতে কৃত সঙ্কল্প হইলেন। গয়া, কাশী, প্রয়াগ এবং শ্রীবৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থ পর্যটন করতঃ বারাণসীতে প্রত্যাগমনকালে ইহার জনক তথায় মানবলীলা সম্বরণ করিলেন। রাণী শরৎসুন্দরী বারাণসীতে মহাসমারোহে পিতৃ শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সমাপনান্তে পুঁঠিয়াতে প্রত্যাগমন করতঃ রাজত্ব ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। অন্যান্য অপরিণামদর্শী ও প্রজাপীড়ক ভূম্যধিকারিগণের ন্যায় ইহার হৃদয় ও অন্তঃকরণ পাষাণ নির্মিত নহে। ইনি অপত্য স্নেহে প্রজাবৃন্দের দুঃখ মোচন ও সুখ বৃদ্ধি করিয়া থাকেন। ইহার দানশীলতা ও পরোপকারিতা জগদ্বিখ্যাত। অনেক স্থানে দরিদ্রবৃন্দের চিকিৎসার্থ দাতব্য ঔষধালয় এবং দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত দেশে বিপুল অর্থ প্রদান করতঃ লোকের অন্নকষ্ট নিবারণে নিয়তই যত্নবর্তী। ১৮৭৭ সালে দিল্লির দরবারে ইনি মহারাণী উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছেন।
“মহারাণী শ্রীমতী শরৎসুন্দরী দেবী সমস্ত বঙ্গ সাম্রাজ্যের রমণীকুলের শিরোভূষণ। ইনি মহারাণী ভবানীর ন্যায় লোকমণ্ডলীর প্রাতঃ স্মরণীয়া। ইনি বরেন্দ্রভূমির গৌরব ও অত্যুজ্জ্বল রত্ন স্বরূপা। ইহার বিশুদ্ধ চরিত্র, পবিত্র দেব ভাব, দানশীলতা ও সহানুভূতি জগজ্জনের অনুকরণীয় আদর্শ। ইনি প্রতিদিন শত শত অনাথা চিরদুঃখিনী বিধবাগণের ভরণপোষণ করেন। রোগ জরাগ্রস্ত মুমূর্ষু দুঃখিনীগণের মৃত্যু শয্যা পার্শ্বে উপবিষ্টা হইয়া স্বয়ং তাহাদিগের সেবা ও শুশ্রূষা করিয়া থাকেন। নারী চরিত্র কতদূর উৎকৃষ্টতা লাভ করিতে পারে, মানবীয় কুপ্রবৃত্তি নিচয় ধর্ম চর্চার মহীয়সী শক্তিতে কতদূর পর্যন্ত নিস্তেজ হইতে পারে, ইনি তাহার জীবিত দৃষ্টান্ত স্থল। অতুল ঐশ্বর্যে অধিকারিণী হইয়াও, প্রাচীনা ভারত মহিলাগণের গৌরবের স্থল। ইনি সতীত্ব, ধর্মনিষ্ঠা, ত্যাগ-স্বীকার ও বিষয়-বাসনা পরিত্যাগ প্রভৃতি সদ্গুণের মহাদর্শ প্রদর্শন করিতেছেন। কি ইংরেজ, কি বঙ্গবাসী, কি হিন্দুস্থানী, সকলেই এক বাক্যে এক হৃদয়ে ইহার যশোকীর্তন করিতেছেন। ০৩০
“নূতন বৎসরের প্রথমদিনে মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবী বিষয় ভার হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। ইহা বাঙালির পক্ষে শুভ সংবাদ নহে। অলৌকিক ধর্মাভাব এবং দানশীলতার জন্য বঙ্গদেশে শরৎসুন্দরী প্রাতঃস্মরণীয়া হইয়াছেন। হিন্দু সন্তানের চক্ষে তিনি পবিত্রা-আর্য-নারী-কুলের আদর্শস্বরূপ। অন্য ধর্মাবলম্বীগণও এক বাক্যে তাহাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করিয়া থাকেন। এরূপ বিশ্বজনীন ভক্তি-প্রীতি যাহার পুরস্কার, তাহার জীবনী আলোচনায় পুণ্য আছে।”
“১২৬৫ সালের আশ্বিন মাসে মহারাণী জন্মগ্রহণ করেন। নিজ পুঁঠিয়াতেই তাহার পিত্রালয়।
পিতা স্বর্গীয় ভৈরবনাথ সান্যাল মহাশয় পুঁঠিয়ার একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার। তিনি গোঁড়া হিন্দু ছিলেন: হিন্দু ধর্মোক্ত সকল ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান বার মাস তাহার গৃহে হইত, আজিও হইয়া থাকে। মহারাণীর মাতা অদ্যাপি জীবিতা আছেন। যে সকল রমণীয় গুণ তাহার চরিত্রের ভূষণ, সচরাচর একাধারে তাহা প্রায় দেখা যায় না। পিতা মাতার সাধুজীবনের দৃষ্টান্ত কেমন কার্যকর, তাহাদের মহত্ত্ব, তাহাদের ধর্মাভাব, সন্তানে কতদূর বিকশিত হইতে পারে, মহারাণী শরৎসুন্দরী তাহার উজ্জ্বলতম প্রমাণ।”
“অতি অল্প বয়সে মহারাণীর বিবাহ হয়। তাহার বয়স তখন ছয় বৎসর, স্বামী স্বর্গীয় রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ তখন দ্বাদশ বর্ষীয় বালক মাত্র। ৩২ পশ্চাৎ শুনা যায়, বিবাহের পূর্বে একজন গণক মহারাণীর বৈধব্য গণনা করিয়াছিল। ত্রয়োদশবর্ষ বয়সে তাহার বৈধব্য ঘটে। পিতামন্ত্রী গণকের গণনা ব্যর্থ করিবার উদ্দেশে স্থির করিয়াছিলেন, বেশি বয়সে পৌত্রীর বিবাহ দিবেন। বলা বাহুল্য তাহা কার্যে পরিণত হইতে পারে নাই। পরিণত হইলে বুঝি বঙ্গ সমাজ মহারাণী শরৎসুন্দরীর নাম কখন শুনিতে পাইত না। যাহা হউক, কিন্তু তাহা হইলে বুঝি দেবী শরৎসুন্দরী জীবনে সুখী হইতে পারিতেন। পবিত্রময়ী মহারাণী শরৎসুন্দরীর গার্য্যস্থ জীবন কেবল দুঃখময়। বাল্যে বিধবা, যৌবনে পিতৃহীনা, হায়! জীবনের সকল ভাগই তাহার কেবল দুঃখময়। চির দুঃখিনী সীতার চিত্র মনে করিয়া যে জাতি অনুদিন পবিত্রতার অশ্রু বিসর্জন করেন, সাব্বী শরৎসুন্দরীর দুঃখ যন্ত্রণাময় জীবনের ইতিহাস বাস্তবিক সে জাতির অর্চণীয় সামগ্রী।”
“১২৭২ সালে শরৎসুন্দরীর হস্তে বিষয় ভার অর্পিত হয়। সেই অবধি কিরূপ প্রশংসা এবং দক্ষতার সহিত তিনি উহা চালাইয়া আসিয়াছেন, এখানে তাহার পরিচয় দিতে হইবে না। গত বৎসর হইতে তাহার কাশীবাসের কথা হইতেছে। সেই অবধি তিনি ইদানীন্তন বিষয় কার্যে অনেকটা হতাদর হইয়াছিলেন।”