বাংলাদেশের কৃষিজমি আজ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহারে। উৎপাদন বাড়ানোর নামে এই নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার এখন খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি এবং জনস্বাস্থ্য সংকটের রূপ নিয়েছে।
অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে কৃষি ও পরিবেশের ক্ষতি
দেশজুড়ে কৃষকেরা বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার করছেন, অধিকাংশ সময় সঠিক প্রশিক্ষণ বা নিরাপদ প্রয়োগবিধি না জেনেই। এর ফলে ফসলই শুধু নয়, মাটির উর্বরতা, পানি এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, “২০১৮ সালে পেস্টিসাইড অ্যাক্ট প্রণয়ন হলেও এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা হয়নি। এর ফলে কীটনাশক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।”
আমদানিতে দ্বিগুণ বৃদ্ধি ও ব্যবহার বিস্ফোরণ
পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ২০০৫ সালে দেশে যেখানে ১২ হাজার টন কীটনাশক আমদানি হয়েছিল, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার টনে—অর্থাৎ ১৫ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি।
তিনি বলেন, প্রতি হেক্টরে কীটনাশক ব্যবহারের সুপারিশকৃত মূল্য ছিল ৯৮ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮২ টাকায়। একইভাবে সারের ব্যবহারও ৮.৫ কেজি থেকে বেড়ে প্রায় ৭০০ কেজিতে পৌঁছেছে।
জৈব কৃষির বিকল্প ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব
প্রাণ বৈচিত্র্য খামারের প্রতিষ্ঠাতা দিলোয়ার জাহান বলেন, “প্রাকৃতিকভাবে চাষ করলে ১০ মণ ফসল পাই, কিন্তু রাসায়নিক ব্যবহার করলে ২৫ মণ পাই। তবে স্বাস্থ্যের ও প্রকৃতির ক্ষতি বিবেচনায় এই বাড়তি ফলন মোটেও লাভজনক নয়।”
গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন ৩৭.৬ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু একই সময়ে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে আরও দ্রুত হারে।
গবেষণায় শনাক্ত ২৫টি অত্যন্ত বিপজ্জনক কীটনাশক
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিস্তৃত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে ২৫টি অত্যন্ত ক্ষতিকর কীটনাশক নিবন্ধিত এবং ব্যবহৃত হচ্ছে।
গবেষণাটি নেতৃত্ব দেন কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস। তিনি জানান, ৩৪৩টি সক্রিয় উপাদান বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর আটটি মানদণ্ড অনুযায়ী এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
শনাক্ত কীটনাশকের মধ্যে ১১টি ইনসেক্টিসাইড, ৭টি ফাঙ্গিসাইড, ৫টি হার্বিসাইড এবং ২টি রোডেনটিসাইড। এসব উপাদান প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক প্রোডাক্টে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাবামেকটিন, ক্লোরপাইরিফস, প্যারাকোয়াট, গ্লাইফোসেট, কারবেনডাজিম, প্রপিকোনাজল, জিঙ্ক ফসফাইড ইত্যাদি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, টমেটো, বরবটি, বেগুনের মতো নিয়মিত খাওয়া সবজিগুলোতে এসব রাসায়নিকের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেশি, যা শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
কৃষকের দারিদ্র্য ও টিকে থাকার লড়াই
বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ কৃষক ভূমিহীন বা ভাগচাষি হওয়ায় টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, সার ভর্তুকি এই অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকায়—গত বছরের চেয়ে চারগুণ বেশি—তবু কৃষকের আয় কমছে।
কৃষি সংগঠক জাহিদুল ইসলাম বলেন, “কৃষি এখন একপ্রকার জুয়ায় পরিণত হয়েছে। এটি লাভজনক হলে কৃষকেরা তাদের সন্তানদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করতেন। এখন উল্টো বড় কোম্পানি ও জমিদাররা জমি কিনছে, ক্ষুদ্র কৃষকরা দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ছে।”
সমাধানের পথ: নিয়ন্ত্রণ, সচেতনতা ও জৈব কৃষি
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবিলম্বে কিছু সংস্কার প্রয়োজন—যেমন শিল্পাঞ্চলের পাশে ফসল চাষ বন্ধ করা, নিয়মিত মাটি ও ফসল পরীক্ষার ব্যবস্থা, ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি।
সরকার ইতিমধ্যে সার চাহিদা মেটাতে ২.৩০ লাখ মেট্রিক টন সার আমদানির অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে সৌদি আরবের স্যাবিক কোম্পানি থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া কেনা হবে ১৫৯.৯৯ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির সদস্য মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, “কীটনাশকের অতিব্যবহার সবার জানা এক গোপন সত্য। আমরা বাজারে নমুনা পরীক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছি। শুধু খাবার নয়, মাটি ও পশুখাদ্যও এখন বিষাক্ত হয়ে পড়েছে; এমনকি গবাদিপশুর ঘাসেও পুষ্টি নেই।”
বাংলাদেশের কৃষি এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে—যেখানে উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু নিরাপদ খাদ্য ও পরিবেশ দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। নিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ব্যবহার, জৈব চাষে প্রণোদনা এবং ভোক্তা সচেতনতার সমন্বয়ই এই ‘বিষাক্ত ফসলের’ অভিশাপ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
# খাদ্য_নিরাপত্তা, কীটনাশক, বাংলাদেশ_কৃষি, পরিবেশ_দূষণ, জনস্বাস্থ্য, সারাক্ষণ_রিপোর্ট