০৬:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫

সন্তান লালনপালনে আসল বিষয় হারিয়ে ফেলছে ‘প্যারেন্টিং’ ট্রেন্ড

সন্তান লালনপালনের নানা পরামর্শ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে—“জেন্টল প্যারেন্টিং”, “অথরিটারিয়ান”, “ফ্রি রেঞ্জ” বা নতুন সংজ্ঞায় “FAFO প্যারেন্টিং”। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব নাম বা লেবেলই এখন পিতামাতাদের প্রকৃত সম্পর্ক ও সংবেদনশীল বোঝাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

সকালবেলার অচেনা দৃশ্য

প্রতিদিনের মতো এক সকালে এক শিশু স্কুলে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব, নতুন টেইলর সুইফটের অ্যালবাম গাইতে প্রস্তুত। অন্যজন মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে—আজ স্কুলে না যাওয়ার জন্য নানা অজুহাত। এই পরিস্থিতিতে মা কখনও “জেন্টল প্যারেন্টিং” তত্ত্ব মনে করেন, কখনও “অথরিটারিয়ান” পন্থা, আবার কখনও ট্রেন্ডিং “FAFO” (mess around and find out) কৌশল, যেখানে শিশুকে পরিণতি বুঝতে দেওয়া হয়।

এই বিপরীতমুখী ধারণাগুলো সামাজিক মাধ্যমে যেন যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে—কেউ সহানুভূতির পক্ষে, কেউ শৃঙ্খলার, কেউ আবার চরম স্বাধীনতার। কিন্তু সত্যি কি এই লেবেলগুলোই আসল সমস্যা নয়?

The Complete Guide to Types of Parenting - Cadence Education

‘লেবেল নয়, শিশুই কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত’

ভ্যানকুভারের প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ভ্যানেসা লাপোয়েন্ট বলেন, “এই নির্দিষ্ট প্যারেন্টিং ক্যাটাগরিতে বিশ্বাস করলে আপনি মূল বিষয়টাই হারান। এতে আমরা বাইরের পরামর্শে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, অথচ প্রয়োজন ছিল নিজের সন্তানের দিকে অন্তর থেকে সাড়া দেওয়া।”

তিনি হাসতে হাসতে বলেন, তাঁর ছোট ছেলেও একসময় ‘মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া’ টাইপ ছিল। “যদি আমি আমার দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে কঠোর থাকতাম এবং সংযোগের জায়গা তৈরি না করতাম, তবে হয়তো সে কিশোর বয়সটা টিকত না।”

সামাজিক মাধ্যমের অতিবিশ্লেষণের ফাঁদ

টরন্টোভিত্তিক থেরাপিস্ট ম্যাকেনজি কিনমন্ড মনে করেন, আগে যেমন “কঠোর বনাম উদার”, “সংযুক্ত বনাম মুক্ত” ধারা ছিল, এখন ইন্টারনেট যুগে এসব দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

“আমাদের সমাজ বিভাজনপ্রীতি সংস্কৃতিতে বাস করে—‘আমরা বনাম তারা’। অ্যালগরিদমও সেটিকে বাড়িয়ে দেয়,” বলেন তিনি।

উদাহরণস্বরূপ, “জেন্টল প্যারেন্টিং” আসলে সীমাহীন নরমতা নয়। বরং এতে উষ্ণতা ও দৃঢ় সীমারেখা দুটোই থাকে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে এটি এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন পিতামাতা কিছুই বলেন না, শুধু শিশুর ইচ্ছেই চলে।

The emotional fallout of coming out to my parents — Assembly | Malala Fund

এই বিভ্রান্তি অনেক পিতামাতাকে ব্যর্থতার অনুভূতিতে ফেলে। কেউ মনে করেন একধরনের কৌশলই শিশুকে নিরাপদ করে, আর অন্যধরন ধ্বংস করে দেয়।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ

কিনমন্ড বলেন, অনেকেই ‘স্টিকার চার্ট’—অর্থাৎ ভালো আচরণের জন্য পুরস্কার ব্যবস্থা—কে এখন অনৈতিক মনে করেন। অথচ তিনি নিজেই সেটি ব্যবহার করেন সকালে শান্তিপূর্ণ রুটিন বজায় রাখতে। তাঁর মতে, আসল ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে বাড়ির ভেতরেই, সামাজিক মাধ্যমে নয়।

“আমাদের আরও বেশি ‘নিজের মতো করে সন্তান লালনপালন’-এর স্বাধীনতা প্রয়োজন,” তিনি বলেন।

লেবেল ফেলে আসল সম্পর্কের সন্ধান

অস্ট্রেলিয়ার ডকুমেন্টারি নির্মাতা স্যাম জোকেল বলেন, তিন সন্তানকে বড় করতে গিয়ে তিনি বুঝেছেন—“লেবেলগুলো সহজ, কিন্তু অলস সমাধান। আসল কাজটা হলো নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা বোঝা, কারণ যেভাবে আমরা বড় হয়েছি, সেটাই আমাদের প্যারেন্টিং নির্ধারণ করে।”

Family watching a movie on a big screen tv in their cozy living room |  Premium AI-generated image

তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র Seen চারজন পিতামাতার গল্প তুলে ধরে, যারা নিজেদের শৈশবের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেন।

জোকেলের মতে, সংকটের মুহূর্তে একটিমাত্র প্রশ্ন তাঁকে সাহায্য করে—“ভালোবাসা হলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিত?” এটি নরমতার নয়, বরং সহানুভূতি ও দৃঢ়তার প্রকাশ।

মানবিক সংযোগই শেষ কথা

লেখক বলেন, মেয়ের পরের দিনও হয়তো মেঝেতে গড়াগড়ি চলবে, আর তিনি হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। কিন্তু এবার তিনি কোনো লেবেল বা ট্রেন্ড খুঁজবেন না—খুঁজবেন সম্পর্কের সংযোগ।

অবশেষে মা ও মেয়ে দুজনই হয়তো সময়মতো বেড়িয়ে যাবেন—কোনো “প্যারেন্টিং স্টাইল”-এর প্রতিনিধি হয়ে নয়, বরং একজন মানুষ ও তাঁর সন্তান হিসেবে, যারা একসঙ্গে শেখার পথে হাঁটছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা বুধবার আদালতে পরবর্তী শুনানি

সন্তান লালনপালনে আসল বিষয় হারিয়ে ফেলছে ‘প্যারেন্টিং’ ট্রেন্ড

০২:০৬:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫

সন্তান লালনপালনের নানা পরামর্শ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে—“জেন্টল প্যারেন্টিং”, “অথরিটারিয়ান”, “ফ্রি রেঞ্জ” বা নতুন সংজ্ঞায় “FAFO প্যারেন্টিং”। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব নাম বা লেবেলই এখন পিতামাতাদের প্রকৃত সম্পর্ক ও সংবেদনশীল বোঝাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

সকালবেলার অচেনা দৃশ্য

প্রতিদিনের মতো এক সকালে এক শিশু স্কুলে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব, নতুন টেইলর সুইফটের অ্যালবাম গাইতে প্রস্তুত। অন্যজন মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে—আজ স্কুলে না যাওয়ার জন্য নানা অজুহাত। এই পরিস্থিতিতে মা কখনও “জেন্টল প্যারেন্টিং” তত্ত্ব মনে করেন, কখনও “অথরিটারিয়ান” পন্থা, আবার কখনও ট্রেন্ডিং “FAFO” (mess around and find out) কৌশল, যেখানে শিশুকে পরিণতি বুঝতে দেওয়া হয়।

এই বিপরীতমুখী ধারণাগুলো সামাজিক মাধ্যমে যেন যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে—কেউ সহানুভূতির পক্ষে, কেউ শৃঙ্খলার, কেউ আবার চরম স্বাধীনতার। কিন্তু সত্যি কি এই লেবেলগুলোই আসল সমস্যা নয়?

The Complete Guide to Types of Parenting - Cadence Education

‘লেবেল নয়, শিশুই কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত’

ভ্যানকুভারের প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ভ্যানেসা লাপোয়েন্ট বলেন, “এই নির্দিষ্ট প্যারেন্টিং ক্যাটাগরিতে বিশ্বাস করলে আপনি মূল বিষয়টাই হারান। এতে আমরা বাইরের পরামর্শে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, অথচ প্রয়োজন ছিল নিজের সন্তানের দিকে অন্তর থেকে সাড়া দেওয়া।”

তিনি হাসতে হাসতে বলেন, তাঁর ছোট ছেলেও একসময় ‘মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া’ টাইপ ছিল। “যদি আমি আমার দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে কঠোর থাকতাম এবং সংযোগের জায়গা তৈরি না করতাম, তবে হয়তো সে কিশোর বয়সটা টিকত না।”

সামাজিক মাধ্যমের অতিবিশ্লেষণের ফাঁদ

টরন্টোভিত্তিক থেরাপিস্ট ম্যাকেনজি কিনমন্ড মনে করেন, আগে যেমন “কঠোর বনাম উদার”, “সংযুক্ত বনাম মুক্ত” ধারা ছিল, এখন ইন্টারনেট যুগে এসব দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

“আমাদের সমাজ বিভাজনপ্রীতি সংস্কৃতিতে বাস করে—‘আমরা বনাম তারা’। অ্যালগরিদমও সেটিকে বাড়িয়ে দেয়,” বলেন তিনি।

উদাহরণস্বরূপ, “জেন্টল প্যারেন্টিং” আসলে সীমাহীন নরমতা নয়। বরং এতে উষ্ণতা ও দৃঢ় সীমারেখা দুটোই থাকে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে এটি এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন পিতামাতা কিছুই বলেন না, শুধু শিশুর ইচ্ছেই চলে।

The emotional fallout of coming out to my parents — Assembly | Malala Fund

এই বিভ্রান্তি অনেক পিতামাতাকে ব্যর্থতার অনুভূতিতে ফেলে। কেউ মনে করেন একধরনের কৌশলই শিশুকে নিরাপদ করে, আর অন্যধরন ধ্বংস করে দেয়।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ

কিনমন্ড বলেন, অনেকেই ‘স্টিকার চার্ট’—অর্থাৎ ভালো আচরণের জন্য পুরস্কার ব্যবস্থা—কে এখন অনৈতিক মনে করেন। অথচ তিনি নিজেই সেটি ব্যবহার করেন সকালে শান্তিপূর্ণ রুটিন বজায় রাখতে। তাঁর মতে, আসল ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে বাড়ির ভেতরেই, সামাজিক মাধ্যমে নয়।

“আমাদের আরও বেশি ‘নিজের মতো করে সন্তান লালনপালন’-এর স্বাধীনতা প্রয়োজন,” তিনি বলেন।

লেবেল ফেলে আসল সম্পর্কের সন্ধান

অস্ট্রেলিয়ার ডকুমেন্টারি নির্মাতা স্যাম জোকেল বলেন, তিন সন্তানকে বড় করতে গিয়ে তিনি বুঝেছেন—“লেবেলগুলো সহজ, কিন্তু অলস সমাধান। আসল কাজটা হলো নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা বোঝা, কারণ যেভাবে আমরা বড় হয়েছি, সেটাই আমাদের প্যারেন্টিং নির্ধারণ করে।”

Family watching a movie on a big screen tv in their cozy living room |  Premium AI-generated image

তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র Seen চারজন পিতামাতার গল্প তুলে ধরে, যারা নিজেদের শৈশবের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেন।

জোকেলের মতে, সংকটের মুহূর্তে একটিমাত্র প্রশ্ন তাঁকে সাহায্য করে—“ভালোবাসা হলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিত?” এটি নরমতার নয়, বরং সহানুভূতি ও দৃঢ়তার প্রকাশ।

মানবিক সংযোগই শেষ কথা

লেখক বলেন, মেয়ের পরের দিনও হয়তো মেঝেতে গড়াগড়ি চলবে, আর তিনি হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। কিন্তু এবার তিনি কোনো লেবেল বা ট্রেন্ড খুঁজবেন না—খুঁজবেন সম্পর্কের সংযোগ।

অবশেষে মা ও মেয়ে দুজনই হয়তো সময়মতো বেড়িয়ে যাবেন—কোনো “প্যারেন্টিং স্টাইল”-এর প্রতিনিধি হয়ে নয়, বরং একজন মানুষ ও তাঁর সন্তান হিসেবে, যারা একসঙ্গে শেখার পথে হাঁটছে।