কানাডার ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলো—যেমন উৎপাদন ও কৃষি—এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির মাধ্যমে। একসময় যেখানে শ্রমনির্ভর ও সময়সাপেক্ষ কাজ ছিল স্বাভাবিক, সেখানে এখন স্মার্ট অ্যালগরিদম ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি গড়ে তুলছে দক্ষ, টেকসই এবং ভবিষ্যৎমুখী শিল্প ব্যবস্থা।
উৎপাদনশিল্পে বুদ্ধিমত্তার সংযোজন
ধরা যাক, আপনার একটি ছোট কারখানা আছে যা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করে। একসময় প্রতিটি অংশের মান যাচাইয়ের দায়িত্ব ছিল কর্মীদের হাতে—যা ছিল পরিশ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ ও ভুলের আশঙ্কাপূর্ণ।
এখন সেই কাজ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফ্রেডেরিকটন-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Eigen Innovations তৈরি করেছে এমন সফটওয়্যার, যা “মেশিন ভিশন” ও এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারখানার মাননিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় করে তুলেছে। এই সিস্টেমে উচ্চক্ষমতার ক্যামেরা প্রতিটি অংশের ছবি তোলে এবং প্রশিক্ষিত এআই মডেলের সঙ্গে তুলনা করে ত্রুটিপূর্ণ অংশ চিহ্নিত করে।
Eigen-এর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা জেমস ফিঞ্চ বলেন, “আমরা এমন অনেক কাজ করি যেখানে মানুষের দেখা সম্ভব নয়—যেমন তাপচিত্র বিশ্লেষণ (থার্মাল ইমেজিং)। এতে অদৃশ্য ত্রুটিও ধরা পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, একবার একটি লাইন স্থাপনের পর একই এআই সিস্টেম সহজেই আরও বহু উৎপাদন লাইনে প্রয়োগ করা যায়, যা ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
শ্রম সংকটে কার্যকর সমাধান
উৎপাদন খাতে শ্রমিক সংকটের সময় এআই কার্যকর বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফিঞ্চের মতে, “যেখানে কর্মী পাওয়া বা ধরে রাখা কঠিন, সেখানে এআই-চালিত পরিদর্শন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষকে আরও মূল্যবান কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব। এতে শ্রমের দক্ষ ব্যবহার বাড়ে, উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং অপচয় কমে।”
Eigen-এর এই প্রযুক্তি কেবল উৎপাদনশীলতা বাড়ায় না, বরং কর্মীদের জন্য কাজকেও আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
কৃষিতে ভার্চুয়াল মাটিপরীক্ষা
কৃষিক্ষেত্রেও কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। উইনিপেগ-ভিত্তিক Farmers Edge মাটিপরীক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
কৃষিতে মাটির গুণগত বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—কোন পুষ্টি উপাদান যোগ করা দরকার, বা মাটির পিএইচ মাত্রা ফসলের ক্ষতি করছে কিনা—এসব জানাই মাটিপরীক্ষার মূল লক্ষ্য।
Farmers Edge গত ১৫ বছরে সংগৃহীত ২ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি পরীক্ষার ডেটার ওপর ভিত্তি করে একটি “ভার্চুয়াল সয়েল টেস্ট” মডেল তৈরি করেছে। প্রথমে একটি আসল মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়, তারপর সেটির সঙ্গে আবহাওয়া, সার প্রয়োগ, পূর্ববর্তী ফলনসহ বিভিন্ন তথ্য যুক্ত করে এআই মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হয়। ফলে প্রতি বছর মাঠে গিয়ে পরীক্ষা না করেও মাটির গুণমান ও ফসলের সম্ভাব্য ফলাফল পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়।
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ক্রিস কিনার্ড বলেন, “অর্থনৈতিক চাপের কারণে অনেক সময় কৃষকরা মাটিপরীক্ষা বাদ দেন। ভার্চুয়াল সয়েল টেস্ট সেই শূন্যতা পূরণ করছে—এটি অনুমাননির্ভর নয়, বরং পরীক্ষিত তথ্যনির্ভর প্রযুক্তি।”
এই মডেলের মাধ্যমে কৃষকেরা বাস্তব পরীক্ষার তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় করতে পারেন এবং একই বিনিয়োগে দ্বিগুণ ফলাফল পেতে পারেন।
ডিজিটাল রূপান্তরে নতুন সম্ভাবনা
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান BDO Canada-এর অংশীদার আহমাদ ওভাইস বলেন, “ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান এখনও তথ্যপ্রযুক্তি ও এআই-এ কম বিনিয়োগ করেছে, ফলে তাদের জন্য আধুনিকীকরণের সুযোগ বিশাল।”
তিনি জানান, “আমাদের এক গ্রাহক—একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান—হাজার হাজার গ্রাহক অনুরোধ হাতে যাচাই করত, ফলে সাড়া দিতে দেরি হতো এবং সুযোগ হাতছাড়া হতো। আমরা এআই-চালিত একটি সিস্টেম তৈরি করেছি যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুরোধ বিশ্লেষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দক্ষতা বেড়েছে ও গ্রাহক সন্তুষ্টি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।”
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার কৌশল
ওভাইসের মতে, ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখন ডিজিটাল রূপান্তর অপরিহার্য।
তিনি বলেন, “যেসব প্রতিষ্ঠান এখনই প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, তারা খরচ কমাবে, দ্রুত গ্রাহকসেবা দেবে এবং তরুণ প্রতিভা আকর্ষণ করবে। যারা দেরি করবে, তারা পিছিয়ে পড়বে—গ্রাহক হারাবে, কর্মী হারাবে, আর বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে।”
তার ভাষায়, “এআই উপেক্ষা করা মানে হলো, রেল ইঞ্জিনের যুগে এসে ঘোড়ার গাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করা—যত দেরি হবে, এগিয়ে যাওয়া তত কঠিন হবে।”
কানাডার ঐতিহ্যবাহী শিল্পখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন এক নীরব বিপ্লব আনছে। উৎপাদন, কৃষি কিংবা সেবা—সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তিনির্ভর এই পরিবর্তন নতুন কর্মসংস্থান, দক্ষতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি করছে। ভবিষ্যতের কানাডা তাই হবে এমন এক অর্থনীতি, যেখানে মানুষ ও মেশিন একসাথে কাজ করবে উৎপাদনশীলতার সর্বোচ্চ সীমা ছোঁয়ার লক্ষ্যে।