খুলনা বিভাগের চার জেলায় রবি মৌসুমকে সামনে রেখে আগাম শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এ বছর ৩০,৩৬৫ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রায় ১৫ দশমিক ২ শতাংশ জমিতে বীজ বপন সম্পন্ন হয়েছে।
কৃষি উৎপাদনে নতুন গতি
খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় কৃষকরা একযোগে জমি প্রস্তুত, বীজ বপন ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরকারি উদ্যোগ ও কৃষকদের অংশগ্রহণে অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বছরজুড়ে চাষাবাদ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শীতকালীন সবজি চাষ এখন এই উদ্যোগের অন্যতম প্রধান অংশে পরিণত হয়েছে।
মাঠজুড়ে বৈচিত্র্যময় সবজি
এ অঞ্চলের মাঠে এখন ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, বরবটি, ঝিঙা, লাল শাক, সাদা শাক (ঘি-কাঞ্চন), পালং শাক ও গাজরসহ নানা ধরনের ফসলের চাষ চলছে। কর্মকর্তারা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জেলার ভিত্তিতে অগ্রগতি
ডিএই-এর তথ্যানুযায়ী:
- • খুলনা জেলায় ৮,৩৩৫ হেক্টর জমির মধ্যে ৪৬৫ হেক্টরে (৫.৬%) চাষ সম্পন্ন হয়েছে।
- • বাগেরহাট জেলায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে—৯,২০০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৩,১২২ হেক্টর (৩৪%) ইতিমধ্যে চাষ হয়েছে।
- • সাতক্ষীরায় ৯,৬৯০ হেক্টরের মধ্যে ৮২২ হেক্টর (৮.৫%) জমিতে চাষ চলছে।
- • নড়াইলে ৩,১৪০ হেক্টরের মধ্যে ২১৫ হেক্টর (৬.৮%) জমিতে চাষ সম্পন্ন হয়েছে।
কৃষকদের আশাবাদ ও শঙ্কা
স্থানীয় কৃষক মো. সাইফুল বলেন, “মানুষ এখন শীতকালীন সবজিতে আগ্রহী, তাই আগাম চাষ শুরু করেছি। প্রায় দেড় সপ্তাহ আগে বীজ বপন করেছি। বাজারে আগাম সবজি উঠলে ভালো দাম পাব বলে আশা করছি।”
অন্যদিকে কৃষক হামিদুল বলেন, “ফুলকপি আর বাঁধাকপি লাগিয়েছি, কিন্তু ফসল কাটার পর দাম পড়ে গেলে কষ্ট হয়। ন্যায্য দাম না পেলে কৃষিতে আগ্রহ কমে যায়।”
মাছচাষি সালাম জানান, তিনি কয়েক বছর ধরে পুকুরের পাড়ে শীতকালে কুমড়া, বরবটি ও লাউ চাষ করেন। “গত বছর ভালো দাম পেয়েছি, আশা করছি এ বছরও লাভবান হব,” বলেন তিনি।
মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধান
কালিয়া উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলাম জানান, সালামাবাদ ইউনিয়নের ধুসাহাটী, বিল বাউচ ও বলাডাঙ্গায় ২০ হেক্টর জমিতে আগাম সবজি চাষ চলছে।
তিনি বলেন, “কৃষকরা বীজ বপন ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আমরা নিয়মিত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছি।”
দিঘলিয়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. কিশোর আহমেদ জানান, এ মৌসুমে নির্ধারিত ৩১৫ হেক্টর জমির মধ্যে ইতিমধ্যে ২০০ হেক্টরে চাষ সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, “সমতল জমির পাশাপাশি পুকুরের পাড়েও সবজি চাষে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়েছে। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে গত বছরের মতো এবারও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।”
খুলনায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্য
খুলনা অঞ্চলের ডিএই-এর অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের লক্ষ্য খুলনাকে আরও কৃষিভিত্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা। এজন্য রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজি চাষের পরিসর বাড়ানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পুকুরের পাড়ে সবজি চাষে, যেখানে কীটনাশকের ব্যবহার খুবই সীমিত। ফলে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি ভোক্তার জন্যও নিরাপদ। কৃষক ও ভোক্তা—উভয়েই এতে উপকৃত হচ্ছেন। প্রতিদিনই চাষের অগ্রগতি বাড়ছে, এবং বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে আমরা পুরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব।”
খুলনা অঞ্চলে আগাম শীতকালীন সবজি চাষের এই অগ্রগতি শুধু স্থানীয় কৃষকদের জীবনমান উন্নত করছে না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকারি প্রণোদনা ও কৃষকদের পরিশ্রম মিলেই এবার রবি মৌসুমে খুলনা বিভাগে সমৃদ্ধ ফসল ঘরে তোলার আশায় মুখর কৃষক সমাজ।
#খুলনা_সবজি_চাষ, রবি_মৌসুম, কৃষি_উন্নয়ন, বাংলাদেশ_কৃষি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট