যুক্তরাষ্ট্রে হতাশা ও উদ্বেগ কমানোর ওষুধ—বিশেষত লেক্সাপ্রো ও জোলফট—এখন অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে আর শুধু চিকিৎসা নয়, বরং এক ধরনের জীবনধারা বা ‘লাইফস্টাইল’ প্রতীক হয়ে উঠছে। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে ইনফ্লুয়েন্সাররা এসব ওষুধ নিয়ে পোস্ট করছেন, নাচছেন, এমনকি ভিডিওতে সেগুলোর প্রশংসা করছেন—ফলে তৈরি হচ্ছে এক নতুন সাংস্কৃতিক প্রবণতা, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা মিশে যাচ্ছে সামাজিক মিডিয়ার জনপ্রিয়তায়।
সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন ট্রেন্ড
২০২৩ সালে টেক্সাসের এক গৃহিণী কোরিন বাইয়ারলি শুনেছিলেন, এক সাবেক এমটিভি তারকা লেক্সাপ্রো নিয়ে প্রশংসা করছেন। অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে না পারলেও তিনি টিকটকে খুঁজে পেলেন #lexaprotok ও অন্যান্য হ্যাশট্যাগের অধীনে এমন এক অনলাইন কমিউনিটি, যেখানে তরুণীরা এন্টিডিপ্রেসেন্টের সুফল নিয়ে কথা বলছে।
বাইয়ারলি অনলাইনে ‘হার্স’ নামের টেলিহেলথ সাইটে প্রশ্নোত্তর দিয়ে লেক্সাপ্রোর জেনেরিক সংস্করণ পেয়ে যান। কয়েকদিনের মধ্যেই ওষুধ হাতে পেয়ে তিনি ভিডিওতে পোস্ট করেন—প্যাকেজ আনতে দৌড়াচ্ছেন, ওষুধ খাচ্ছেন, লিখছেন হ্যাশট্যাগ #lexaprobaddies ও #gethelpmama। কয়েক মাস ধরে তিনি তাঁর অনুসারীদের জানান, এই ওষুধ তাঁকে “বহু বছরের মানসিক কোলাহল থেকে মুক্তি দিয়েছে।”
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি
কিন্তু আনন্দ স্থায়ী হয়নি। কিছুদিন পর বাইয়ারলি অনুভব করেন, তাঁর আবেগ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, মস্তিষ্কে ধোঁয়াশা, যৌন আগ্রহ হারানো ও ওজন বৃদ্ধি। প্রথমে এসব লুকিয়ে রাখলেও পরে তিনি খোলাখুলিভাবে টিকটকে জানান, “ওষুধগুলো প্রথমে সাহায্য করেছিল, কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সবকিছু ভেঙে দিয়েছে।”
মার্কিন তথ্য অনুযায়ী, মহামারির পর থেকে তরুণ নারীদের মধ্যে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহারের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে টিকটকে #antidepressants হ্যাশট্যাগের ভিডিও দেখা হয়েছে ১.৩ বিলিয়ন বারের বেশি, #lexapro হ্যাশট্যাগের দেখা সংখ্যা ৫০ কোটিরও বেশি।
ওষুধ থেকে ‘লাইফস্টাইল এক্সেসরি’
টেলিহেলথ কোম্পানিগুলো ইনফ্লুয়েন্সারদের এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়েছে। অনেক তরুণ ইনফ্লুয়েন্সার টিকটকে ওষুধ খাওয়ার ভিডিও বানাচ্ছেন, নাচছেন, এমনকি “লেক্সাপ্রো মিশ্রিত আইসড কফি ছাড়া কথা বলো না” লেখা টি-শার্ট বিক্রি করছেন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. জোসেফ উইট-ডোরিং বলেন, “আজকাল অনেকেই তাদের প্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারের মাধ্যমে এন্টিডিপ্রেসেন্টকে ফ্যাশনেবল মনে করছে। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি কেবল একটি বড়ির মাধ্যমে সমাধান হয় না।”
‘আমাকে স্বাভাবিক রাখে’
টিকটক তারকা অ্যালিক্স আর্ল, যার অনুসারী ৭৭ লাখ, জানান তিনি উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই উদ্বেগের চিকিৎসায় লেক্সাপ্রো নিচ্ছেন। তাঁর ভিডিওটি ৬১ লাখ মানুষ দেখেছেন, যেখানে তিনি বলেন, “এটা আমার মস্তিষ্কের ভারসাম্য ঠিক রাখে—আমাকে স্বাভাবিক রাখে।”
তবে তাঁর মতো প্রভাবিত হয়ে অনেক তরুণীও ওষুধ নিতে শুরু করেন, কিন্তু সবাই একই ফল পাননি। যুক্তরাজ্যের এক তরুণী জানান, ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিডিও দেখে আবার চেষ্টা করলেও তাঁর অনুভূতি নিস্তেজ হয়ে যায়, যৌন ইচ্ছা হারিয়ে যায়—আর এই প্রভাব রয়ে গেছে বছরের পর বছর।
বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা
এক গবেষণায় দেখা গেছে, এন্টিডিপ্রেসেন্ট গ্রহণকারীদের মাত্র ১৫ শতাংশের ক্ষেত্রে প্লাসিবো প্রভাবের বাইরে প্রকৃত সুফল পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে একজন ব্যক্তি টানা পাঁচ বছর পর্যন্ত এসব ওষুধ গ্রহণ করেন, যদিও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতার প্রমাণ সীমিত। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোগী দীর্ঘ ব্যবহারের পর ওষুধ ছাড়ার সময় মাঝারি বা তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগেন।
টিকটক প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস ও বিভ্রম
২৪ বছর বয়সী ম্যাকেনজি টিডওয়েল নিজেকে “গর্বিত জোলফট ব্যবহারকারী” বলেন। তিনি নাচের পাশাপাশি ভিডিওতে লেখেন—“প্রিটি গার্লস টেক এসএসআরআইস।” তাঁর মতে, অন্যদের ভিডিও তাঁকে সাহস দিয়েছে সাহায্য নিতে। তিনি বলেন, “এই আলোচনা আমাকে একা অনুভব করতে দেয় না।”
অর্থায়ন ও মার্কেটিং
‘হিমস অ্যান্ড হার্স হেলথ’ নামের টেলিহেলথ কোম্পানি ২০২১ সাল থেকে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ৫২১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। কোম্পানিটি ইনফ্লুয়েন্সারদের ৩ থেকে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত দেয় প্রচারের জন্য। তাদের মূল বার্তা—“ডিপ্রেশন বা উদ্বেগের চিকিৎসা লজ্জার নয়।”
কিন্তু কিছু ইনফ্লুয়েন্সার, যেমন নাদিয়া ওকামোটো, পরবর্তীতে প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, ওষুধ তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দিয়েছে এবং ঘুমের সময় অতিরিক্ত ঘামাচ্ছে। তিনি বলেন, “ডাক্তাররা প্রায়ই শুধু ডোজ বাড়ানোর পরামর্শ দেন, যেন দুঃখ বোধ করা মানবিক নয়।”
ওষুধ ছাড়ার কঠিন বাস্তবতা
ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার অ্যারিয়েলা শার্ফ জানান, জোলফট প্রথমে তাঁকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু পরে তাঁর ক্ষুধা ও অনুভূতি হারিয়ে যায়। ওষুধ ছাড়ার পর তিনি মাথা ঘোরা, শরীর কাঁপা ও বমিভাবের শিকার হন। তিনি বলেন, “ডাক্তাররা কখনোই বিশ্বাস করেন না যে ওষুধ ছাড়াটা এত কষ্টকর হতে পারে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় এন্টিডিপ্রেসেন্ট এখন যেন আত্ম-উন্নয়ন বা ফ্যাশনের প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে এটি এক গভীর মানসিক ও শারীরিক প্রক্রিয়া, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বহুবার জীবন বদলে দেয়। চিকিৎসকরা বলছেন—ওষুধ প্রয়োজন হলে অবশ্যই নেওয়া উচিত, তবে ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রচারে নয়, বরং চিকিৎসকের পরামর্শেই।
#এন্টিডিপ্রেসেন্ট, #টিকটক,# মানসিক_স্বাস্থ্য, #ইনফ্লুয়েন্সার,# লেক্সাপ্রো,# জোলফট,# যুক্তরাষ্ট্র,# সারাক্ষণ_রিপোর্ট