মালদ্বীপে কর্মরত ভারতীয় প্রবাসীদের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) নতুন রেমিট্যান্স নীতি। ব্যাংকটি সম্প্রতি দেশটির ভারতীয় প্রবাসীদের জন্য টাকা পাঠানোর সীমা নির্ধারণ করেছে মাত্র ১৫০ ডলার (প্রায় ১৩,১৮৮ রুপি)। ফলে যারা প্রতি মাসে লাখ লাখ রুপি উপার্জন করেন, তারাও এখন দেশে পরিবারের খরচ পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
জীবনের স্থিতি থেকে আর্থিক সংকটে
প্রায় এক দশক ধরে মালদ্বীপে বসবাস করছেন ডেন্টিস্ট ডা. অঞ্জিথা এবং তার স্বামী ফিজিওথেরাপিস্ট উদয়কৃষ্ণন পি। তারা নিয়মিত আয় ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু নভেম্বর মাসে দেশে ফিরলেও হাতে থাকবে মাত্র ১৩,০০০ রুপি—যদিও মাসিক আয় তিন লাখ রুপি ছাড়ায়।
উদয়কৃষ্ণনের ভাষায়, “আমাদের নিজের টাকায়ই হাত দিতে পারছি না। এসবিআই এখন শুধু ১৫০ ডলার পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে, এটিএম বা অনলাইন পেমেন্টও বন্ধ করে দিয়েছে মালদ্বীপের বাইরে।”
ডলার সংকটের অজুহাত
এসবিআই জানিয়েছে, মালদ্বীপে ডলার সংকটের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশটি ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ২০২৬ সাল পর্যন্ত টিকে থাকতে দেশটির কমপক্ষে ১.০৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ প্রয়োজন। চীন ও ভারত মালদ্বীপের প্রধান ঋণদাতা।
ব্যাংকের দাবি, এই সীমাবদ্ধতা শুধু মালদ্বীপীয় রুফিয়া (MVR) অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; ডলার অ্যাকাউন্ট থেকে রেমিট্যান্সে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সমস্যাটি হলো, ডলারে বেতন পান শুধু পর্যটন খাতের কর্মীরা, অন্য সবাই রুফিয়াতে বেতন পান।
কঠোর নিয়মে মালদ্বীপের ব্যাংক ব্যবস্থা
মালদ্বীপ মনিটারি অথরিটি (এমএমএ)-এর ২০২৪ সালের অক্টোবরের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, অনুমোদিত ক্যাটাগরির বাইরে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করলে ১০,০০০ থেকে ১০ লাখ রুফিয়া পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে (প্রায় ৫৭,৫০০ থেকে ৫৭.৫ লাখ রুপি)।
পর্যটন খাত পুনরুদ্ধারের পরও দেশটি ডলার ঘাটতিতে ভুগছে। খাদ্য ও জ্বালানির আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারি ঋণের বোঝা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে এমএমএ পর্যটন খাত থেকে অর্জিত ডলারের ৯০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে বাধ্য করেছে, যা আগে ছিল ৬০ শতাংশ।
প্রবাসীদের ক্ষোভ
পর্যটন শিক্ষক মনু মাধব বলেন, “দেশে ডলার সংকট আমরা বুঝি, কিন্তু এসবিআইয়ের এই সিদ্ধান্তের কোনো যুক্তি নেই। এটি শুধু ভারতীয় প্রবাসীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।” তিনি জানান, মালদ্বীপ ব্যাংক বিদেশে কার্ড ব্যবহারের সীমা বরং ৫০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১,০০০ ডলার করেছে।
মালদ্বীপে অবস্থানরত ভারতীয় প্রবাসীরা এ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাইকমিশনের কাছে আবেদন করলেও আশানুরূপ সাড়া পাননি। হাইকমিশন জানিয়েছে, তারা দুই দেশের সরকারের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় সহজ করতে আলোচনা করছে, যাতে রুপি-রুফিয়া সরাসরি লেনদেন চালু করা যায় এবং ইউপিআই পেমেন্ট ব্যবস্থাও কার্যকর হয়।
তবে হাইকমিশনের পরামর্শ—“রেমিট্যান্স পরিকল্পনা করুন”, “বেতন ডলারে দেওয়ার জন্য নিয়োগকর্তাকে উৎসাহিত করুন”—প্রবাসীদের আরও ক্ষুব্ধ করেছে। এক প্রবাসী মন্তব্য করেন, “আমরা কি এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, আমাদের বেতন ডলারে দিন?”
পরিবার ও ঋণের সংকট
উদয়কৃষ্ণন জানান, তার দুই সহকর্মীর গাড়ি ও বাড়ি কেনার ঋণ রয়েছে। “১৫,০০০ রুপি কিস্তি দিতে হয়, কিন্তু এখন পাঠাতে পারছেন মাত্র ১৩,০০০ রুপি। ফলে তারা ঋণখেলাপির পথে।”
শিক্ষক মনু মাধব বলেন, “আমরা পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ড পাই না, তাই ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু এখন সেটিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
নতুন কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে
মালদ্বীপ সরকার এখনো ভারতে নার্স ও শিক্ষক নিয়োগের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। আবেদনকারীরা চাকরি পেতে ২.৫ থেকে ৩ লাখ রুপি পর্যন্ত ব্যয় করেন। কিন্তু তারা জানেন না, দেশে পাঠাতে পারবেন মাত্র ১৩,০০০ রুপি।
প্রবাসীদের আয় ও ব্যয়
মালদ্বীপে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মাসে ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ রুফিয়া (প্রায় ৩.৫–৪.৫ লাখ রুপি) আয় করেন। সাধারণ ডাক্তারদের বেতন ২০,০০০–৩০,০০০ রুফিয়া, নার্স ও শিক্ষকরা পান ১৮,০০০–২৫,০০০ রুফিয়া।
মাসিক ব্যয়ের মধ্যে বাড়িভাড়া গড়ে ৩,০০০–৪,০০০ রুফিয়া, খাদ্য ব্যয় ৩,০০০ রুফিয়া, অন্যান্য খরচ ২,০০০ রুফিয়া। ফলে আগের মতো অন্তত ৫০,০০০ রুপি দেশে পাঠানো সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন সেই সুযোগ নেই।
ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স সীমা হ্রাস
২০১৪ সালে এসবিআই ডাক্তারদের জন্য ১,২০০ ডলার এবং শিক্ষক-নার্সদের জন্য ৭০০ ডলার পর্যন্ত রেমিট্যান্সের অনুমতি দিত। কোভিডের সময় তা কমে হয় ১,০০০ ও ৫০০ ডলার। ২০২৪ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৪০০ ডলারে, এবং এখন মাত্র ১৫০ ডলারে নেমেছে।
কালোবাজারে ডলার বেচাকেনা
ব্যাংকিং খাতে ডলার সংকট থাকলেও কালোবাজারে মুদ্রা সহজলভ্য। তবে ৪৩ শতাংশ বেশি দামে। সরকার ১৬ সেপ্টেম্বর ৩০ বছর বয়সী এক বাংলাদেশিকে অবৈধভাবে ডলার লেনদেনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে।
এক ডলারের সরকারি বিনিময় হার ১৫.৩০ রুফিয়া হলেও কালোবাজারে তা ২২ রুফিয়া পর্যন্ত উঠেছে। ৫০,০০০ রুপি দেশে পাঠাতে কালোবাজারের ডলার কিনতে অতিরিক্ত ৩,৮০০ রুফিয়া (প্রায় ২২,০০০ রুপি) খরচ হয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক কৌশল
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজজু সরকারি ব্যয় সংকোচন করেছেন—নিজের বেতন অর্ধেকে কমিয়ে সরকারি কর্মচারীদের ১০ শতাংশ কাটা দিয়েছেন। তার লক্ষ্য, দেশটিকে শুধু পর্যটননির্ভর না রেখে একটি গোপন আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
দুবাইভিত্তিক এমবিএস গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্টসের ৮.৮ বিলিয়ন ডলারের সহায়তায় মালদ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার নির্মাণ চলছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি সম্পন্ন হলে প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডলার আয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারত ও মালদ্বীপ যদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জুলাই সফরে আলোচিত রুপি–রুফিয়া সরাসরি বিনিময় ব্যবস্থা চালু করতে পারে, তবে প্রবাসী ভারতীয়দের কষ্ট অনেকটা কমবে বলে আশা করছেন উদয়কৃষ্ণন। তিনি বলেন, “নভেম্বরের ছুটিতে যাওয়ার আগে যদি ব্যবস্থা কার্যকর হয়, তাহলে আমরা বাঁচি।”