জাপানের সংসদ মঙ্গলবার দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সানায়ে তাকাইচিকে নির্বাচিত করেছে। এর মাধ্যমে দেশটি তিন মাসের রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাকাইচির নেতৃত্বে রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) এখন নতুন ডানপন্থী জোটসঙ্গীর সঙ্গে ক্ষমতায় ফিরেছে।
নেতৃত্বের পরিবর্তন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা মাত্র এক বছরের মেয়াদ শেষে পদত্যাগ করেন, তার মন্ত্রিসভাসহ। জুলাইয়ের নির্বাচনে এলডিপির বিপর্যয়কর পরাজয়ের পর দলটি নেতৃত্বহীন অবস্থায় ছিল। তাকাইচি সেই শূন্যতা পূরণ করে দলকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
সংসদের নিম্নকক্ষে তাকাইচি ২৩৭ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন, যা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে চার ভোট বেশি। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিরোধী সাংবিধানিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ইয়োশিকো নোদা, যিনি পান ১৪৯ ভোট।
নতুন জোট ও রক্ষণশীল অবস্থান
এই জয় সম্ভব হয়েছে ওসাকা-ভিত্তিক ডানপন্থী জাপান ইনোভেশন পার্টি (ইশিন নো কাই)-এর সঙ্গে তাকাইচির হঠাৎ গঠিত জোটের কারণে। তবে এই জোট এখনো সংসদের দুই কক্ষেই পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে আইন পাস করতে তাকাইচিকে অন্যান্য ছোট দলের সহযোগিতা নিতে হবে, যা তার সরকারের স্থায়িত্বকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
সোমবার ওসাকা গভর্নর হিরোফুমি ইয়োশিমুরার সঙ্গে জোট চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তাকাইচি বলেন,
“বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে জরুরি। স্থিতিশীলতা না থাকলে আমরা অর্থনীতি বা কূটনীতি— কোনোটিতেই এগোতে পারব না।”
চুক্তিতে উভয় দলই কঠোর জাতীয়তাবাদী ও প্রতিরক্ষা-কেন্দ্রিক নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
দীর্ঘদিনের জোটভাঙা ও ক্ষমতার ভারসাম্য
লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দীর্ঘদিন বৌদ্ধঘনিষ্ঠ কোমেইতো পার্টির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এসেছে। কিন্তু কোমেইতো তাদের মধ্যপন্থী অবস্থান ধরে রেখে এবার এলডিপি থেকে দূরে সরে যায়। এর ফলে এলডিপি প্রথমবারের মতো ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় পড়ে।
তাকাইচির নতুন মন্ত্রিসভায় এলডিপির প্রভাবশালী নেতা তারো আসো-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী স্থান পাচ্ছেন। তবে জাপান ইনোভেশন পার্টি আপাতত কোনো মন্ত্রীপদ নিচ্ছে না, যতক্ষণ না তারা এলডিপির সঙ্গে সম্পর্কের স্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে।
আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও নীতি অগ্রাধিকার
৬৪ বছর বয়সী তাকাইচির সামনে এখন একাধিক জরুরি চ্যালেঞ্জ। তাকে সপ্তাহের শেষেই বড় নীতিগত ভাষণ দিতে হবে, এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আঞ্চলিক সম্মেলনগুলোর সঙ্গে বৈঠক রয়েছে।
বর্ধিত মূল্যস্ফীতি ও জনঅসন্তোষ কমাতে ডিসেম্বরের মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
নারীর অধিকার ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে বিতর্ক
যদিও তাকাইচি জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, তিনি লিঙ্গসমতা বা বৈচিত্র্য প্রসারে তেমন আগ্রহ দেখাননি। বরং তিনি নারীর অগ্রগতির পদক্ষেপগুলো আটকে দেওয়ার জন্য সমালোচিত। তিনি রাজপরিবারে পুরুষ উত্তরাধিকার প্রথাকে সমর্থন করেন এবং সমলিঙ্গ বিবাহ বা বিবাহিত দম্পতির পৃথক পদবির বিরোধিতা করেন।
শিনজো আবের ছায়ায় তাকাইচি
প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ শিষ্য হিসেবে তাকাইচি তার সামরিক ও অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে জাপানের শান্তিবাদী সংবিধান সংশোধনের প্রচেষ্টা এবং সামরিক শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা।
তবে নতুন জোটের ভঙ্গুর অবস্থায় তার কতটা ক্ষমতা প্রয়োগ সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
কোমেইতো পার্টি এলডিপির ‘অর্থ কেলেঙ্কারি’ ও গোপন তহবিলের দুর্নীতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে জোট ছাড়ে। এছাড়া তাকাইচির যুদ্ধ-ইতিহাস বিষয়ক বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি, ইয়াসুকুনি মন্দিরে তার নিয়মিত প্রার্থনা ও বিদেশবিদ্বেষী মন্তব্য নিয়েও বিরোধী পক্ষের উদ্বেগ রয়েছে।
বেইজিং ও সিউল বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে, কারণ ইয়াসুকুনি মন্দির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের সম্মান জানায়। তবে এবার তাকাইচি সরাসরি সেখানে না গিয়ে প্রতীকীভাবে একটি ধর্মীয় উপহার পাঠিয়েছেন— যা তার কূটনৈতিক ভারসাম্যের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সানায়ে তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করল— যেখানে নারী নেতৃত্ব, রক্ষণশীল নীতি, এবং জাতীয়তাবাদী জোটের ভারসাম্য মিলেমিশে আছে। এখন দেখার বিষয়, তিনি কীভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক বিভাজন মোকাবিলা করেন।
#জাপান,# সানায়ে তাকাইচি,# জাপান সংসদ,# লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, #রাজনীতি,# বিশ্ব সংবাদ,# সারাক্ষণ রিপোর্ট