যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালে কথিত “ডিপ স্টেট” বিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতায় গঠিত হয়েছে এক বহুমাত্রিক সরকারি নেটওয়ার্ক। ‘ইন্টারএজেন্সি ওয়েপনাইজেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ নামে এই গোপন সমন্বয়ক সংস্থা এখনো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে—যার মূল লক্ষ্য ট্রাম্পের বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া এবং পূর্ববর্তী প্রশাসনের তথাকথিত ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ খুঁজে বের করা।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে জন্ম ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে নির্দেশ দেন, আইনজীবী ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেন একসঙ্গে কাজ করে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার “অস্ত্রীকরণ” সংক্রান্ত অতীতের অনিয়মগুলো শনাক্ত করে তা সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়।
এই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস, সিআইএ, এফবিআই, প্রতিরক্ষা ও বিচার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও টেলিকম কমিশনসহ প্রায় চল্লিশটি সংস্থার কর্মকর্তারা যুক্ত হন ‘ইন্টারএজেন্সি ওয়েপনাইজেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এ।

উদ্দেশ্য: ‘ডিপ স্টেট’ নির্মূল অভিযান
ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের ভাষায় “ডিপ স্টেট” বলতে বোঝানো হয় এমন এক অদৃশ্য প্রশাসনিক নেটওয়ার্ককে, যারা তাঁর বিরোধী হিসেবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গ্রুপটির মূল লক্ষ্য—২০১৬ সালের রাশিয়া নির্বাচনী হস্তক্ষেপ তদন্ত, ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া ও ৬ জানুয়ারির দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলাগুলোর প্রতিশোধ নেওয়া।
একজন কর্মকর্তার ভাষায়, “এই ওয়ার্কিং গ্রুপ মূলত সেই ‘ডিপ স্টেট’ কাঠামোকেই লক্ষ্য করছে, যারা ট্রাম্পকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”
প্রশাসনের ভেতরে বহুমাত্রিক অংশগ্রহণ
রয়টার্স পর্যালোচনায় জানা গেছে, ৩৯ জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত—যাদের মধ্যে রয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, আইনজীবী, এমনকি সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যও।

ওডিএনআই (Office of the Director of National Intelligence) মুখপাত্র অলিভিয়া কোলম্যান জানান, “আমেরিকানরা এমন এক সরকার পাওয়ার যোগ্য, যা কখনোই জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ব্যবহার করবে না।”
অন্যদিকে, বিচার বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরেও আলাদা ‘ওয়েপনাইজেশন ইউনিট’ গঠন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন কর্মকর্তারা।
কারা আলোচনায় এসেছেন
সূত্র জানায়, গ্রুপের বৈঠকগুলোতে আলোচিত হয়েছে সাবেক এফবিআই প্রধান জেমস কোমি, কোভিড উপদেষ্টা অ্যান্থনি ফাউচি এবং সেই সামরিক কর্মকর্তাদের নাম, যারা সেনাদের জন্য বাধ্যতামূলক টিকা কার্যক্রম চালু করেছিলেন।
এ ছাড়াও, আলোচনার পরিসর বাড়িয়ে ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরিবার—যেমন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনকেও আলোচনায় আনা হয়েছে।
তবে ওডিএনআই দাবি করেছে, “কোনো ব্যক্তিকে প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে টার্গেট করা হয়নি; বরং অবৈধ সরকারি অস্ত্রীকরণ প্রমাণের জন্য প্রমাণ-ভিত্তিক অনুসন্ধান চলছে।”

বিতর্কিত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা
ওই গ্রুপের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে আছেন বিচার বিভাগের অ্যাটর্নি এড মার্টিন, যিনি জানুয়ারি ৬-এর দাঙ্গায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সেনেট কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন।
এছাড়া, ট্রাম্পের মিথ্যা নির্বাচনী জালিয়াতি দাবির সমর্থক এবং টিকা-বিরোধী কর্মকর্তারাও এই নেটওয়ার্কে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান ও গোপন অভিযানের অভিযোগ
সূত্রের দাবি, ওডিএনআই ইতোমধ্যে তথাকথিত ‘ডিপ স্টেট’ চিহ্নিত করতে “টেকনিক্যাল টুল” ব্যবহার শুরু করেছে, যা পরবর্তীতে শ্রেণিবদ্ধ তথ্য নেটওয়ার্কেও সম্প্রসারিত হতে পারে।
যদিও, ওডিএনআই এই দাবি নাকচ করে জানায়, “এ ধরনের অনুসন্ধান আমাদের সিস্টেমের কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”

রাশিয়া তদন্ত থেকে জানুয়ারি ৬: প্রতিশোধের এজেন্ডা
গ্রুপের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০১৬ সালের রাশিয়া হস্তক্ষেপ তদন্তে জড়িত কর্মকর্তাদের “অপসারণ” করা।
টুলসি গ্যাবার্ডের নেতৃত্বাধীন আরেকটি ইউনিট ডিআইজি (DIG) দাবি করেছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১৭ সালের গোয়েন্দা রিপোর্ট ‘মনগড়া’ভাবে তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন—যা ওবামা প্রশাসন অস্বীকার করেছে।
তবে ২০২০ সালের সিনেট রিপোর্ট ও ২০২৫ সালের সিআইএ পুনঃমূল্যায়ন উভয়ই প্রমাণ করেছে যে রাশিয়া ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিল।
অন্য আলোচ্য বিষয়সমূহ
গ্রুপের আলোচনায় উঠে এসেছে আরও কিছু বিষয়—যেমন: জেফ্রি এপস্টিনের নথি, ট্রাম্পের উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন ও পিটার নাভারোর মামলা, এমনকি ট্রান্সজেন্ডার কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলের সম্ভাবনাও।
তবে হোয়াইট হাউস ও ওডিএনআই উভয়েই এসব আলোচনার বিষয়বস্তু অস্বীকার করেছে।
![]()
ট্রাম্পপন্থী কর্মকর্তাদের আধিক্য
গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে অনেকে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমর্থক। উদাহরণস্বরূপ, প্রাক্তন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সেক্রেটারি অব স্টেট ম্যাক ওয়ার্নার, যিনি দাবি করেছিলেন—“সিআইএ ২০২০ সালের নির্বাচন চুরি করেছে।”
এছাড়া অন্তত চারজন হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের এক সহকারী, এবং জানুয়ারি ৬ দাঙ্গায় অংশ নেওয়া সাবেক এফবিআই এজেন্ট জ্যারেড ওয়াইজও এই গ্রুপে যুক্ত আছেন বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে।
রয়টার্সের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই ‘ইন্টারএজেন্সি ওয়েপনাইজেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর গভীরে বিস্তৃত এক রাজনৈতিক নেটওয়ার্কে রূপ নিয়েছে।
সরকারি ক্ষমতা ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়, তবে এবার তা এক নতুন আকারে সামনে এসেছে—যেখানে প্রতিশোধ, নীতি প্রভাব এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য একসূত্রে গাঁথা হয়েছে।
#ডোনাল্ড_ট্রাম্প #ডিপ_স্টেট #যুক্তরাষ্ট্র #রাশিয়া_তদন্ত #জানুয়ারি৬ #ওডিএনআই #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















