‘ডেডবিট’-এ টেম ইমপালার নিখুঁততা—কিন্তু কোথায় সেই প্রাণ?
অস্ট্রেলিয়ান সঙ্গীতশিল্পী কেভিন পার্কারের একক প্রকল্প টেম ইমপালা দীর্ঘদিন ধরেই সূক্ষ্ম প্রযোজনা, মন্থর ছন্দ, এবং উষ্ণ সাউন্ডের জন্য পরিচিত। তার নতুন অ্যালবাম ‘ডেডবিট’ (Columbia Records) সেই ধারা বজায় রেখেও এক নতুন প্রশ্ন তোলে—নিখুঁততার অন্বেষণে কি হারিয়ে গেছে মানবিক অনুভূতির উষ্ণতা?
সঙ্গীত ফরম্যাটের বিবর্তন ও টেম ইমপালার অবস্থান
দশকের পর দশক ধরে সঙ্গীতের ফরম্যাট বদলে এসেছে।
- • ১৯৪০-এর দশকে লং-প্লেয়িং ভিনাইল শিল্পীদের দীর্ঘ, কনসেপ্টভিত্তিক অ্যালবাম তৈরি করতে উৎসাহিত করেছিল।
- • ১৯৮০-এর দশকে সিডি প্রযুক্তি সাউন্ডকে আরও তীক্ষ্ণ ও প্রাণবন্ত করেছিল।
- • আর স্ট্রিমিং যুগে “ব্যাকগ্রাউন্ড লিসেনিং” বা অ্যালগরিদম-নির্ভর শ্রবণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে টেম ইমপালা ব্যতিক্রমী। কেভিন পার্কার নিজেই গান লেখেন, বাজান, রেকর্ড করেন ও প্রযোজনা করেন। তার অ্যালবামগুলো কেবল ‘ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক’ নয়—তাতে শ্রোতা খুঁজে পান ধীর কিন্তু গভীর এক প্রশান্তি।

নিখুঁততার চূড়ান্ত পরিণতি: ‘ডেডবিট’
প্রথম দুটি অ্যালবাম ‘Innerspeaker’ (২০১০) ও ‘Lonerism’ (২০১২) ছিল সাইকেডেলিক রকের প্রাণবন্ত পরীক্ষা।
এরপর ‘Currents’ (২০১৫) ও ‘The Slow Rush’ (২০২০)-এ তিনি সাউন্ডে এনেছিলেন আরও পরিশীলন ও নিয়ন্ত্রণ।
কিন্তু ‘Deadbeat’ সেই পরিপূর্ণতার চূড়ায় পৌঁছে কখনও কখনও অত্যধিক মসৃণ ও “নিরাপদ” শোনায়।
অ্যালবামের সূচনা গান ‘My Old Ways’-এ পার্কার যেন নিজেকেই ব্যঙ্গ করেন। এক অপরিষ্কার, সামান্য বেসুরো পিয়ানোতে ডেমো অংশটি শোনায় মানবিক, কিন্তু পরে সেটিই মিলিয়ে যায় সম্পূর্ণ পালিশকৃত ভার্সনে। এরপর বহুস্তরীয় ভয়েস ট্র্যাক, টুইঙ্কলিং সিন্থ, এবং স্থির ৪/৪ হাউস বিটে গড়ে ওঠে এক পরিমিত, ক্লাব-বান্ধব রিদম—তবুও কিছু যেন অনুপস্থিত থেকে যায়।
সাইকেডেলিক রক ও নাচের সঙ্গীতের সংযোগ
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ম্যানচেস্টারের Happy Mondays ও Stone Roses সাইকেডেলিক রককে নাচের বিটের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
পার্কারের প্রচেষ্টায় সেই ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি থাকলেও উন্মত্ততা বা বিস্ময়ের জায়গায় এসেছে গাণিতিক নিখুঁততা।

‘No Reply’-এর টম-টম বিট আর অর্ধেক বলা কণ্ঠ যেন সময় মাপার যন্ত্রের মতো নির্ভুল।
আর ‘Oblivion’-এর প্রতিধ্বনিময় কণ্ঠ এতটাই হালকা যে মনে হয় শব্দগুলো বাতাসে ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
গীতিকবিতার অন্তরালে
পার্কার তার কণ্ঠকে এত প্রক্রিয়াজাত করেন যে অনেক সময় তার গীতিকবিতার বুদ্ধিদীপ্ততা আড়ালে চলে যায়।
‘Dracula’-তে তিনি নিজেকে কল্পনা করেন রাতের “মিস্টার ক্যারিশমা” হিসেবে, সকালে যিনি ক্লান্ত ও পরাজিত মানুষ।
আর ‘Piece of Heaven’-এ, এনিয়া-ধাঁচের সুরে তিনি নিজের একান্ত নিঃসঙ্গতাকেই স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করেন।
পরিশুদ্ধ সাউন্ডের সীমাবদ্ধতা
অ্যালবামের কয়েকটি গানে পার্কারের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট—একটি ভারমুক্ত, স্বাভাবিক জীবন।

‘Not My World’ তুলনামূলকভাবে সরল এবং সৎ—যেখানে হালকা ইলেকট্রনিক ক্লিকের সঙ্গে বেস সিন্থের ভারসাম্য এক ধরনের শান্ত বৈচিত্র্য আনে।
তবুও পুরো অ্যালবামজুড়ে নিখুঁততার এমন দখল যে, শ্রোতা মুগ্ধ হলেও সেই নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো স্বতঃস্ফূর্ততা অনুপস্থিত।
পপ জগতের প্রভাব
রিহানা, লেডি গাগা ও দুয়া লিপার মতো তারকাদের সঙ্গে কাজের পর পার্কারের সঙ্গীতে মূলধারার পপ প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে।
এক সময়ের ব্যতিক্রমী পরীক্ষামূলক সাউন্ড এখন হয়ে উঠেছে নিখুঁত, কিন্তু পূর্বানুমেয়।
‘Deadbeat’ নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ স্টুডিও প্রোডাকশন, কিন্তু এতে নেই সেই ঝুঁকি বা সৃজনশীল উন্মাদনা, যা টেম ইমপালাকে একসময় অনন্য করেছিল।
টেম ইমপালার নতুন অ্যালবাম একদিকে প্রযুক্তিগত সাফল্যের প্রতীক, অন্যদিকে মানবিক অনিশ্চয়তার অনুপস্থিতির এক প্রতিফলন।
কেভিন পার্কার আবারও প্রমাণ করেছেন, তিনি সাউন্ড নির্মাণে এক স্থপতি। কিন্তু হয়তো সেই নিখুঁত প্রাচীরের ভেতরে বন্দি হয়েছে সঙ্গীতের সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান—ভুল করার সাহস।
#টেম_ইমপালা, কেভিন_পার্কার, ডেডবিট, সাইকেডেলিক_রক, আধুনিক_সঙ্গীত, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















