একই ছাতার নিচে থাকা ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার’-এর (ASD) ভিন্নমাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেক অভিভাবক ও চিকিৎসক মনে করছেন, ‘প্রফাউন্ড অটিজম’ বা গভীর অটিজমকে আলাদা শ্রেণিতে চিহ্নিত করা জরুরি, যাতে গবেষণা ও চিকিৎসা আরও কার্যকরভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়।
পারিবারিক প্রেক্ষাপট: এক ছাদের নিচে দুই ভিন্ন বাস্তবতা
ওরেগন রাজ্যের সেলেমের বাসিন্দা পেটন লুগহিড ২৯ বছর বয়সে নিজের অটিজম শনাক্ত হওয়ার পর বুঝতে পারেন, জীবনের অনেক প্রশ্নের উত্তর এভাবে মিলছে। কিন্তু তিনি কোনো বিশেষ সেবা গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেননি। অন্যদিকে তাঁর আট বছর বয়সী ছেলে গ্রেইসন দুই বছর বয়সে অটিজমে আক্রান্ত হিসেবে নির্ণীত হয়, যিনি এখনো প্রায় বাকরুদ্ধ, রাতে ডায়াপার পরে, হঠাৎ আচমকা রাগ বা কান্নার বিস্ফোরণ ঘটে।
লুগহিড নিজে অটিজমের লেভেল ১ পর্যায়ে (হালকা মাত্রা), আর তাঁর ছেলে লেভেল ৩ (গভীর মাত্রা)। তবুও তাঁদের দুজনের নির্ণয় একই—‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার’। এই বৈপরীত্য থেকেই শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়—একটি শব্দ কি সত্যিই এত বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাকে ধারণ করতে পারে?
“আমার ছেলের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা”—মায়ের অভিজ্ঞতা
লুগহিড বলেন, “আমি বিয়েও করেছি, সন্তানও নিয়েছি, চাকরিও করেছি—অটিজম আমার জীবনে কোনো সীমাবদ্ধতা আনেনি। কিন্তু আমার ছেলে একদম আলাদা বাস্তবতায় আছে। আমি মনে করি, আমাদের দুজনের জন্য আলাদা শ্রেণিবিন্যাস থাকা উচিত, যাতে তাঁর মতো বাচ্চারা বাড়তি সহায়তা পেতে পারে।”
বস্টন চিলড্রেন’স হাসপাতালের ক্লিনিকাল প্রধান ড. ম্যাথিউ সিগেল এই যুক্তিকে সমর্থন করে বলেন, “একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও একজন নীরব, নির্ভরশীল ব্যক্তির জন্য একই শব্দ ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত নয়। এতে উভয়েরই ক্ষতি হয়।”
‘প্রফাউন্ড অটিজম’—আলাদা নির্ণয়ের প্রস্তাব
ড. সিগেল সম্প্রতি একটি বিশেষজ্ঞদলকে নেতৃত্ব দেন, যারা ‘প্রফাউন্ড অটিজম’-এর সংজ্ঞা প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। তাঁদের মতে, এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তির আইকিউ ৫০-এর নিচে, মৌখিক দক্ষতা সীমিত, এবং সার্বক্ষণিক প্রাপ্তবয়স্ক তত্ত্বাবধান প্রয়োজন হয়।
এই সংজ্ঞাটি ২০২১ সালে দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণার কাছাকাছি। উদ্দেশ্য হলো এই শ্রেণির মানুষের ওপর গবেষণার মানোন্নয়ন করা এবং তাদের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সেবা ব্যবস্থা সামঞ্জস্য করা।
অটিজম নির্ণয়ের ইতিহাস
অটিজম প্রথম যুক্ত হয় ১৯৮০ সালে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিজঅর্ডারস (DSM)-এ, যেখানে একে বিরল শিশুতোষ অবস্থা হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
১৯৯৪ সালে DSM এই সংজ্ঞা সম্প্রসারিত করে ‘অ্যাসপারগার সিনড্রোম’ যুক্ত করে—যেখানে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় সমস্যা থাকলেও বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক বা উচ্চ ছিল। তবে, নির্ণয়ের অসামঞ্জস্যতা সমস্যার মূল হয়ে দাঁড়ায়—একই উপসর্গে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ফলাফল দেখা যেত।
ইউসিএলএর অধ্যাপক ক্যাথরিন লর্ড বলেন, “গবেষণার ফলাফল অনেক সময় নির্ভর করত শিশুটি কোথায় নির্ণীত হয়েছে তার ওপর, তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের ওপর নয়।”
গবেষণার জটিলতা ও মানবীয় সীমারেখা
বস্টন ইউনিভার্সিটির হেলেন টেগার-ফ্লুসবার্গ বলেন, “মানুষের মস্তিষ্ক বা আচরণকে স্পষ্ট সীমানায় ভাগ করা সহজ নয়—এ কারণেই সাবগ্রুপ নির্ধারণ বৈজ্ঞানিকভাবে কঠিন।”
২০১৩ সালে DSM চারটি সাবটাইপ বাতিল করে একটি একীভূত শ্রেণি ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার’ তৈরি করে, যার তিনটি তীব্রতার স্তর রয়েছে।
অধ্যাপক লর্ডের মতে, “সবাইকে এক কাঠামোয় ফেলা যায় না। কেউ সার্বক্ষণিক যত্ন চায়, আবার কেউ কেবল সামাজিক যোগাযোগে সহায়তা প্রয়োজন করে।”
তিন প্রজন্মের গল্প
লুগহিড জানান, তাঁর বাবাও নাতির নির্ণয়ের পর লেভেল ১ অটিজমে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন।
তাঁর ছেলে গ্রেইসন দুই বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কথা বলত, এরপর হঠাৎ ভাষাগত দক্ষতা হারিয়ে ফেলে। এখন সে একা খেলতে পছন্দ করে, বিশেষ করে ডাইনোসরের খেলনা নিয়ে, কিন্তু অন্য শিশুদের সঙ্গে তেমন মিশে না।
তাঁর ঘরে একটি ক্যামেরা বসানো আছে—কারণ, এক ঘণ্টা দেখাশোনা না করলে সে অগোছালো আচরণে লিপ্ত হতে পারে। গ্রেইসনের জন্য নিয়ম, রুটিন ও পরিবেশ অপরিহার্য; পরিবর্তন ঘটলে সে দীর্ঘ সময় ধরে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
পরিবার এখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নেমেছে—তারা আলাবামায় ২৫ একর জমি কিনে একটি খামারে চলে যাচ্ছে, যেখানে একদিন গ্রেইসন নিজস্ব গেস্টহাউসে স্বাধীনভাবে (তত্ত্বাবধানে) বসবাস করতে পারবে—এই আশাই এখন তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন।
লুগহিড বলেন, “আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করি, কিন্তু আমার ছেলে তা পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের মতো মানুষদের কণ্ঠ অবশ্যই থাকা উচিত, তবে আমাদের কারণে তাঁর মতোদের জন্য গবেষণা আটকে থাকা উচিত নয়।”
এই বক্তব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে চলমান বিতর্কের মূল সুর—অটিজম কি একক অভিজ্ঞতার নাম, না কি এটি এমন এক বিস্তৃত পরিসর, যেখানে প্রতিটি জীবন আলাদা যত্ন ও বোঝাপড়া দাবি করে?
#অটিজম,# প্রফাউন্ড অটিজম,# যুক্তরাষ্ট্র,# স্বাস্