কাম্বোডিয়ার রাজধানী ফনম পেনের দক্ষিণে নির্মিত ২ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিমানবন্দর—‘টেচো ইন্টারন্যাশনাল’—দেশটির পর্যটন ও বৈশ্বিক ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের নতুন উদ্যোগ। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, স্থাপত্যের নান্দনিকতা ও জাতীয় গর্ব মিলিয়ে এটি এখন কাম্বোডিয়ার উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক।
ধর্মীয় আচার আর শুভ সূচনাসেপ্টেম্বরের শুরুতে, আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যে কমলা বস্ত্র পরিহিত ভিক্ষুরা সমবেত হন বিমানবন্দরের যাত্রী প্রস্থান হলে। তারা আশীর্বাদ দেন ৩০ ফুট উচ্চতার সোনালি বুদ্ধমূর্তিকে—যার নিচেই যাত্রীদের পথচলা শুরু হবে।
নয় টন ওজনের এই মূর্তি আশীর্বাদ পাওয়ার পরই বিমান অবতরণ শুরু হয়। চার দিন পর, চীনের গুয়াংজৌ থেকে আসা এয়ার কাম্বোডিয়ার প্রথম ফ্লাইটটি জলকামান অভ্যর্থনায় অবতরণ করে, আর আগমন হলে ঐতিহ্যবাহী খমের নৃত্যশিল্পীরা রেশমের পোশাকে পরিবেশন করেন স্বাগত নৃত্য।
উদ্বোধন ও সরকারের আশা
অক্টোবরের ২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বিমানবন্দরটি। তিনি বলেন, “এটি কাম্বোডিয়ার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির নতুন সাফল্য।”

দেশটির সরকার আশা করছে, এই আধুনিক বিমানবন্দরই হবে পর্যটন বৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের তুলনায় কাম্বোডিয়া এখনও পর্যটকে পিছিয়ে—যেখানে বছরে মাত্র ২৫ লাখ বিদেশি আসে, সেখানে থাইল্যান্ডে যায় ৩ কোটি ২০ লাখ, আর ভিয়েতনামে ১ কোটি ৮০ লাখ।
নকশা ও স্থাপত্য—আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ
ফনম পেন থেকে প্রায় ১৮ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত এই ৮৭ হাজার বর্গফুটের স্থাপনা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ফস্টার + পার্টনারস-এর নকশায় নির্মিত। ছাদের ঢেউখেলানো আকৃতি অনুপ্রাণিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী আপসারা নৃত্যশিল্পীর মুকুট থেকে।
অভ্যন্তরে প্রচুর প্রাকৃতিক আলো, কাচঘেরা দেয়াল, কাঠের মেঝে ও সবুজ উদ্ভিদে তৈরি হয়েছে প্রশান্ত পরিবেশ।
স্থপতি নিকোলাই মালশ জানান, নকশার মূল ভাবনা ছিল সহজ চলাচল—যাত্রী যেন কখনও দিকভ্রান্ত না হয়। টার্মিনালের প্রান্ত থেকে প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটার সর্বোচ্চ দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটার।
কাম্বোডিয়ার স্বকীয়তায় নকশার ছোঁয়া
ছাদের বক্র অংশ শুধু সৌন্দর্যের নয়—এটি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার অংশও। স্থানীয় কফি ব্র্যান্ড ‘ব্রাউন কফি’ নির্মাণকালে শ্রমিকদের জন্য প্রথমেই কফিশপ খুলে ফেলে।
বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কাম্বোডিয়া এয়ারপোর্ট ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির পরিচালক চার্লস ভ্যান বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এই বিমানবন্দর নিজেই হবে এক আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য, যেমন দুবাই বা লন্ডনের বিমানবন্দর।”

জাতীয় গর্বের প্রতীক
সরকার এটিকে শুধু অবকাঠামো নয়, বরং জাতীয় গর্ব হিসেবে দেখছে। এখানে রয়েছে মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেশন এবং নিজস্ব থিম সং—‘পাওয়ার অব টেচো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’, যা প্রধানমন্ত্রী মানেত নিজে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন।
তার ভাষায়, “বিমান চলাচল খাত পর্যটন, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সংযোগের অন্যতম সেতুবন্ধন। আমরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোকে আধুনিকায়ন করছি যেন যাত্রীরা আরও সহজে সংযুক্ত হতে পারেন।”
আঞ্চলিক সংযোগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা
২০২৩ সালে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর আওতায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সিয়েম রিপ-আঙ্কোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উদ্বোধনের পর, টেচো প্রকল্পটি এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ উদ্যোগ।
দুটো বিমানবন্দরই কাম্বোডিয়ার ‘সেক্রেড ট্যুরিজম ২০২৫–২০৩৫’ পরিকল্পনার মূল অংশ, যেখানে স্বাস্থ্যভিত্তিক, কৃষি ও গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আঙ্কোর ওয়াট ছাড়াও নতুন পর্যটন এলাকা তৈরি করা হচ্ছে।
বৈশ্বিক যোগাযোগ ও নতুন রুট
টেচো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এখন সরাসরি ফ্লাইট যাচ্ছে ব্যাংকক, বেইজিং, হ্যানয়, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুরে। আসন্ন মৌসুমে তুর্কিশ এয়ারলাইনস ও এতিহাদ এয়ারওয়েজ চালু করবে ইস্তাম্বুল ও আবুধাবির রুট—এর ফলে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা যাত্রীরা আরও সহজে কাম্বোডিয়া পৌঁছাতে পারবেন।

নিরাপত্তা ও ভাবমূর্তির চ্যালেঞ্জ
তবে উদ্বোধনের মাত্র চার দিন আগে দক্ষিণ কোরিয়া কাম্বোডিয়ার কিছু অঞ্চলে ‘কোড ব্ল্যাক’ ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে—এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায়। আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতারাও ফনম পেন ও অন্যান্য অঞ্চলে অপরাধ ও পুরনো যুদ্ধবিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করছে।
এভিয়েশন বিশ্লেষক শুকর ইউসুফ বলেন, “শুধু একটি ঝকঝকে বিমানবন্দর পর্যটক আনতে যথেষ্ট নয়। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম সংস্কৃতি, খাবার ও নিরাপত্তায় অনেক এগিয়ে।”
তিনি আরও বলেন, “আঙ্কোর ওয়াট বা ‘কিলিং ফিল্ডস’ ছাড়া কাম্বোডিয়ায় পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো জায়গা সীমিত, এবং দেশটি এখনো প্রতারণা ও মানবপাচারের কেন্দ্র হিসেবে কুখ্যাতি কাটাতে সংগ্রাম করছে।”
পরবর্তী ধাপ ও পুরোনো বিমানবন্দরের ভবিষ্যৎ
‘টেচো’ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ফনম পেন শহরের কেন্দ্রের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। আপাতত যাত্রীরা ব্যক্তিগত গাড়ি বা টুকটুকে চড়ে নতুন মহাসড়ক দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছাচ্ছেন।
অন্যদিকে পুরনো ফনম পেন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং এর ভবিষ্যৎ ব্যবহারের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও হয়নি।
সোনালি বুদ্ধমূর্তির আশীর্বাদে যাত্রা শুরু করা ‘টেচো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ এখন ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। কাম্বোডিয়া তাদের স্বপ্নের বিমানবন্দর তৈরি করেছে—এখন কেবল বিশ্বের পর্যটকদের আগমনই বাকি।
#কাম্বোডিয়া,# বিমানবন্দর, #টেচো ইন্টারন্যাশনাল, #পর্যটন, #ফনম পেন, #বেল্ট অ্যান্ড রোড, #হুন মানেত,# দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,# অবকাঠামো উন্নয়ন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















