বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটে জয় পেয়েছেন খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা রদ্রিগো পাজ। প্রায় দুই দশকের বামপন্থী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ৫৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী এই মধ্যপন্থী রাজনীতিক আগামী ৮ নভেম্বর দায়িত্ব নেবেন। তবে তার সামনে অপেক্ষা করছে উচ্চ ঋণ, দুর্বল রাজস্বব্যবস্থা ও বিভক্ত সংসদের কঠিন বাস্তবতা।
প্রেক্ষাপট: প্রবাসে জন্ম, রাজনীতিতে উত্তরাধিকার
৫৮ বছর বয়সী রদ্রিগো পাজ জন্মগ্রহণ করেন স্পেনের সান্তিয়াগো দে কম্পোস্তেলায়, যখন তার পরিবার রাজনৈতিক নির্বাসনে ছিল। তার পিতা হাইমে পাজ জামোরা ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সামরিক শাসনের সময় দেশত্যাগের পর পাজ যুক্তরাষ্ট্রে জেসুইট স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে ওয়াশিংটনের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
তার শৈশব ছিল নাটকীয় ও ট্র্যাজেডিতে ভরা—তার পিতা এক বিমান দুর্ঘটনা থেকে একমাত্র জীবিত উদ্ধার হন, আর তার মা রহস্যজনক এক গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান। এই অভিজ্ঞতাগুলো পাজের মানসিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা গঠনে বড় প্রভাব ফেলেছে।
রাজনৈতিক যাত্রা: স্থানীয় রাজনীতি থেকে জাতীয় নেতৃত্বে
১৯৮০-এর দশকে পরিবার দেশে ফেরার পর রদ্রিগো পাজ তারিজা শহর থেকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন। সিটি কাউন্সিলর থেকে সিনেটর পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করেন। তিনি সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটে কাজ করেছেন—বামঘেঁষা রেভল্যুশনারি লেফট মুভমেন্ট থেকে শুরু করে ডানপন্থী গোষ্ঠী পর্যন্ত।

নির্বাচনে তিনি নিজেকে “কেন্দ্রপন্থী” হিসেবে তুলে ধরেন—দরিদ্রদের জন্য সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তবে অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেন।
অর্থনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি
রদ্রিগো পাজ কর কাঠামো সহজীকরণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আঞ্চলিক সরকারগুলোকে আরও বেশি আর্থিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পাশাপাশি লোকসানী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার বা বন্ধের পরিকল্পনাও তার ঘোষণায় রয়েছে।
তার ভাষায়, “রাষ্ট্র এখন অনেক সময় নাগরিকদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়—অনেকে কাজ না করেও সরকারি বেতন পান। এই প্রবণতা থামাতে হবে।”
তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নগদ ভাতা কর্মসূচি বন্ধ হবে না। অক্টোবরের ১২ তারিখের টেলিভিশন বিতর্কে তিনি বলেন, “প্রথম দিন থেকেই জ্বালানি সরবরাহ ও সামাজিক সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকবে, একই সঙ্গে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হবে।”
অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ
বলিভিয়া বর্তমানে উচ্চ ঋণ ও রাজস্ব ঘাটতির মুখে। নতুন প্রশাসনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে এই ঋণ পুনর্গঠন। পাজ ইতোমধ্যে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং আন্তঃআমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা ঋণ পুনর্গঠনের আলোচনা শুরু করেছি। এটি বলিভিয়ার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
আন্তর্জাতিক নীতি: পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন
পাজ ঘোষণা দিয়েছেন, তার সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দেবে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখলেও তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনর্নির্মাণে আগ্রহী।
সংসদীয় বাস্তবতা ও রাজনৈতিক জোটের প্রয়োজন
আগস্টে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে তার খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নিম্নকক্ষে ১৩০ আসনের মধ্যে ৪৯টি এবং সিনেটে ৩৬ আসনের মধ্যে ১৬টি আসন পেয়েছে। অর্থাৎ, কার্যকর সরকার পরিচালনার জন্য পাজকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হবে।
বিশ্লেষণ: অর্থনীতি ও ঐক্যের কঠিন পরীক্ষা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বলিভিয়ার অর্থনৈতিক সংকট এতটাই গভীর যে নতুন সরকারকে দ্রুত কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলা ও পুনর্গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ জোনাথন ফর্চুন বলেন, “রাজস্ব ঘাটতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার কত দ্রুত, কতটা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।”
রদ্রিগো পাজের জয় বলিভিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে—যেখানে দীর্ঘদিনের বামপন্থী আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে মধ্যপন্থী নেতৃত্বের উত্থান ঘটেছে। তবে তার সামনে রয়েছে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ঐক্য গঠন ও জনগণের আস্থা বজায় রাখার কঠিন পরীক্ষা।
#বলিভিয়া নির্বাচন,# রদ্রিগো পাজ, #বলিভিয়ার রাজনীতি,# খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, #লাতিন আমেরিকা, #সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















