ইবসেনের ক্লাসিক নাটকের আধুনিক পুনর্জন্ম
নিয়া দা কস্তা পরিচালিত ‘হেডা’ চলচ্চিত্রটি হেনরিক ইবসেনের ১৮৯১ সালের বিখ্যাত নাটক হেডা গাবলার–এর এক নতুন রূপান্তর। গল্পটি এবার স্থান পেয়েছে ১৯৫০-এর দশকের প্রেক্ষাপটে, যেখানে মূল নাটকের একঘরে সামাজিক বন্দিত্বকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে উন্মুক্ত দৃশ্যপট, জনসমাগম ও নাচ–গানের আভিজাত্যে।
চলচ্চিত্রটিতে হেডার চরিত্রে অভিনয় করেছেন টেসা থম্পসন, যিনি একাধারে বিদ্রোহী, আত্মমগ্ন এবং সামাজিকভাবে অস্থির এক নারীর ভূমিকায়। দা কস্তা দৃশ্যত এক সমৃদ্ধ রূপ দিয়েছেন ক্লাসিক নাটকটিকে—একঘরে আবদ্ধ নারীচরিত্রকে এবার দেখা যায় নাচের মঞ্চে, বিলাসবহুল পার্টিতে, কিংবা ভিড়ের ভেতরে লাল গাউনে হেঁটে যেতে।
নতুন সময়, নতুন পরিচয়
এই সংস্করণের হেডা শুধু অসুখী গৃহবধূ নন; তিনি কৃষ্ণাঙ্গ, উভকামী, এবং নিজের অতীত প্রেমিকা আইলিন লাভবার্গের (মূল নাটকের পুরুষ চরিত্র আইলার্ট লভবার্গের আধুনিক রূপ) প্রতি এখনো টান অনুভব করেন। আইলিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিনা হস, যিনি একসময় মাতাল হলেও এখন নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন এবং হেডার স্বামী জর্জ টেসম্যানের (টম বেটম্যান) প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।

এদিকে টেসম্যানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রিনউডের (ফিনবার লিঞ্চ) নিয়োগের ওপর, যিনি তাঁদের আয়োজিত জমকালো পার্টিতেও উপস্থিত থাকবেন। সেই পার্টিতেই এক অতিথি আশঙ্কা করেন, কিছু ভয়ংকর ঘটতে চলেছে। হেডা তাতে জবাব দেন, “পার্টি ছাড়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো, কিছু ভয়ংকর ঘটার পর—কিন্তু পুলিশের আসার আগেই।”
চিত্রায়ণ ও সংলাপে নতুন পরীক্ষা
দা কস্তা, যিনি এর আগে ক্যান্ডিম্যান ও লিটল উডস–এর মতো কাজের জন্য পরিচিত, নিজেই এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন। চিত্রগ্রাহক শন ববিটের (১২ ইয়ার্স আ স্লেভ) ক্যামেরায় টেসা থম্পসনের হেডা হয়ে ওঠে এক জটিল, কিন্তু শক্তিশালী প্রতিচ্ছবি। হিলডুর গুদনাদোত্তির সংগীত ও দৃশ্যনির্মাণ একে দেয় নাটকীয়, প্রায় অপেরার মতো গতি।
তবে পরিচালক মূল গল্পে পরিবর্তন আনলেও, তা আবার ইবসেনের অগ্রগামীতাকেই নতুনভাবে প্রকাশ করে। উনিশ শতকে যে সামাজিক বিদ্রোহ ইবসেন করেছিলেন, আজ তা নতুন আঙ্গিকে ফিরে এসেছে বর্ণ, লিঙ্গ ও শ্রেণি–সংকটের আলোচনায়।
নতুন প্রেক্ষাপটে ‘হেডা’র দ্বন্দ্ব
দা কস্তা এখানে রঙ–নিরপেক্ষ কাস্টিংয়ের প্রয়োগ করেছেন, যা গল্পকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। হেডা ও বিচারক ব্র্যাক (নিকোলাস পিনক)—উভয়েই কৃষ্ণাঙ্গ; এই জাতিগত প্রেক্ষাপট তাঁদের সম্পর্ককে দেয় নতুন রাজনৈতিক মাত্রা। তবে এতে হেডার মূল অস্তিত্বসংকট—গৃহবন্দি জীবনের মানসিক দমবন্ধ অবস্থা—কখনো কখনো পেছনে চলে যায়।

হেডার বিপরীতে আছে থিয়া ক্লিফটন (ইমোজেন পুটস), যিনি আইলিনের নতুন বইয়ের সহলেখক ও তার মুক্তির অনুপ্রেরণা। অথচ হেডা চায় এই পুনর্জাগরণ ব্যর্থ হোক—যে বিদ্বেষই শেষ পর্যন্ত তাঁকে চালিত করে আত্মধ্বংসের পথে।
যুক্তি ও সীমাবদ্ধতা
চলচ্চিত্রে দেখা যায়, আইলিন তার বইয়ের একমাত্র পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসে টেসম্যান দম্পতির পার্টিতে। ১৮৯১ সালে এটি যুক্তিযুক্ত ছিল, কিন্তু ১৯৫০-এর প্রেক্ষাপটে এমন একক কপি থাকা অনেকটাই অবিশ্বাস্য। তবুও এই ‘বই’–ই হেডার কাছে একধরনের ‘ক্রিপ্টোনাইট’—যা তার স্বামীর ক্যারিয়ার ও নিজের সামাজিক মর্যাদার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
হেডা চায় সম্মানিত নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি, আবার চায় স্বাধীনতা ও বিপ্লবী উচ্ছ্বাস। এই দ্বৈত সত্তাই তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে—একদিকে উচ্চবিত্ত নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে সমাজে বর্ণ ও লিঙ্গ–বৈষম্যের প্রতীক।

পরিশেষে
নিয়া দা কস্তা তার হেডা–তে নারী, জাতি, ও সামাজিক অবস্থানকে নতুন আলোয় দেখিয়েছেন। টেসা থম্পসনের অভিনয় এই পুনর্নির্মাণকে দিয়েছে দৃঢ় ভিত্তি, যদিও ইবসেনের মূল ‘মানসিক বদ্ধতা’র গভীরতা এখানে মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যায়। তবুও এটি এমন এক সাহসী প্রয়াস, যা ক্লাসিক নাটককে সমসাময়িক সংলাপে ফিরিয়ে আনে—চমকপ্রদ, দৃষ্টিনন্দন, এবং ভাবনাজাগানিয়া।
# হেডা,# হেনরিক ইবসেন, #টেসা থম্পসন,# নিয়া দা কস্তা,# প্রাইম ভিডিও, #ক্লাসিক নাটক, #চলচ্চিত্র সমালোচনা, #সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















