“আমি নিজে থেকে এখানে আসিনি। আমাকে ডাকা হলেই কেবলমাত্র আমি আসতে পারি।”
কায়রোতে ইমাম হুসাইনের মাজার হিসেবে পরিচিত হুসাইনি মসজিদে বসে আমাকে কথাগুলো বলছিলেন শিরিন।
তিনি বলছিলেন, ইসলামের নবী মোহাম্মদের নাতির মাজারের দর্শন কেবলমাত্র তখনই পাওয়া যাবে, যখন কেউ বিশেষ ধরনের ‘দাওয়াত’ পাবেন।
বহু মিশরীয়, যাদের মধ্যে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সবাই আছেন, তারা বিশ্বাস করেন––’ইমামের ডাক’ নামে পরিচিত এ দাওয়াত ইমাম হুসাইন কেবলমাত্র তার প্রিয় মানুষদের পাঠান, তা সে ব্যক্তি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন।
তাদের বিশ্বাস, ইমাম হুসাইনের মাজারে কেবল তাদের পক্ষেই যাওয়া সম্ভব যাদের ইমাম নিজে অনুমতি দিয়েছেন। ইমাম নিজে যাদের ডাকেন – তারাই মাজারে প্রবেশ করতে পারেন এবং মাজারের সামনে দাঁড়াতে পারেন।
“ঠিক যেমন বিনা দাওয়াতে কেউ কারো বাড়িতে যেতে পারে না, তেমনি ইমাম হুসাইনের দর্শন পাওয়ার ব্যাপারটিও তাই। তিনি যদি না চান, তাহলে আপনি মাজারের সামনে পৌঁছে যাওয়ার পরও তার দর্শন না পেতে পারেন,” বিবিসি অ্যারাবিককে বলেন শিরিন।
এ কথা শুনে আমাল জাইদের ‘বিটউইন টু নেইবারস’ সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল আমার, যেখানে সাইদ নামের এক চরিত্র এক জায়গায় বলে ওঠেন যে, “আমাকে ইমাম হুসাইন ডেকেছিলেন, আমি সাড়া দিয়েছি”।
শিরিনের বিশ্বাস ইমাম হুসাইনের দরগায় যারাই এসেছেন, তারা কেউ খালি হাতে ফেরেননি।
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ইমাম হুসাইনের জন্ম উৎসব, যার নাম মৌলিদ, যখন পালন হয় শিরিন তখন মাজারে আসেন না।

কারণ সে সময়ে অনেক ভিড় থাকে, ফলে মাজারে ঢুকতে ঝামেলা হতে পারে – এই ভয়ে শিরিন তখন সেই কটা দিন এড়িয়ে যান, কিন্তু তিনি প্রায়ই এই মাজারে আসেন।
দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে আসা হাজারো পর্যটকের কাছে কায়রোর একদম কেন্দ্রে অবস্থিত ইমাম হুসাইনের মাজারটি একটি অন্যতম বড় আকর্ষণ।
মৌলিদের সময় এই পুরো মাজার এবং আশপাশের এলাকা ভক্ত আর দর্শনার্থীদের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে, পা ফেলার জায়গা থাকে না সেখানে।
আড়ম্বরপূর্ণ, ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন এই জনপদে ইমাম হুসাইনের জন্মবার্ষিকী পালন হয়, বছরে দুইবার।
ইমাম হুসাইন ইবনে আলি, ইসলামের নবী মোহাম্মদের নাতি হিজরি বর্ষপঞ্জির চতুর্থ বছরের শাবান মাসে জন্মেছিলেন।
কিন্তু মিসরে তার জন্মদিন পালন হয় রাবি-উস-সানি মাসের শেষ মঙ্গলবারে এবং এ উদযাপনটি তার আসল জন্মদিনের চাইতে বড় হয়।
এ বছর তার জন্মদিন পালন করা হয়েছে ২১শে অক্টোবর।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পৃথক বা ভিন্ন উদযাপনের পেছনে কারণ কী?
‘মিসরীয়দের আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম’
মিসরীয় সাংবাদিক নাওয়ারা নাজম বলছেন, ইমাম হুসাইনের মাধ্যমে মিসরীয় মানুষজন আহলে আল-বাইতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
ইসলাম ধর্মে আহলে আল-বাইত বলতে নবী মোহাম্মদের পরিবারকে বোঝায়।
মানসিক প্রশান্তির জন্য নাওয়ারা প্রায়ই ইমাম হুসাইনের মাজারে যান।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, বহু মিসরীয় বিশ্বাস করেন ইমাম হুসাইনের শির বা মস্তক মিসরে সমাহিত করা হয়েছে।
তাদের বিশ্বাস ইমাম হুসাইনের শির এই দেশটিতে পৌঁছনো যেন মিসরের জন্য এক আধ্যাত্মিক সূচনা, অন্য কথায় এটি মিসরীয়দের এক আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম।
আর সে কারণেই দেশটির বাসিন্দারা গৌরব আর আনন্দের সাথে মৌলিদ পালন করে।
নাওয়ারার মত প্রায় একই কথা বলছিলেন কায়রোর হুসাইনি মসজিদের ইমাম ড. মোমিন আল-খালিজি। তিনি বিবিসিকে বলেন, মৌলিদ পালনের মধ্য দিয়ে মিসরীয়রা ইমাম হুসাইনের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে।
যদিও ইমাম হুসাইনের শির মিসরের ঠিক কোন জায়গায় সমাহিত করা হয়েছে, তা নিয়ে মত-ভিন্নতা আছে। কিন্তু মিসরীয়রা তাদের অন্তরে ইমাম হুসাইনকে বিশেষ জায়গায় রেখেছে।
আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল বাকি আল-কাত্তান বলেছেন, অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ইমাম হুসাইনের শির কায়রোতে পৌঁছেছিল হিজরি ৫৪৮ সালের জামাদা আস-সানি, মানে আরবি বর্ষপঞ্জির ষষ্ঠ মাসের আট তারিখে।
কিন্তু মিসরীয়রা ওই নির্দিষ্ট দিনের দুই মাস আগে এ দিবস পালন করে।

এর কারণ হয়ত ওই সময়ে অর্থাৎ রাবি-উস-সানি মাসের শেষদিকে ইমাম হুসাইনের শির ফিলিস্তিনের উপকূলীয় শহর আশকেলন থেকে মিসরে পাঠানো হয়েছিল, বলছেন অধ্যাপক আব্দুল বাকি আল-কাত্তান।
তবে, ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, ইমাম হুসাইনের শির পরের বছর অর্থাৎ হিজরি ৫৪৯ সালে কায়রো পৌঁছেছিল।
হুসাইনি মসজিদের ইমাম ড. মোমিন আল-খালিজি বলেন, মিসরীয়রা ওই দিনটিকে ‘ইশতবিশার’, মানে যেদিন সুসংবাদ এসেছিল, বলে পালন করেন।
অনেক ইসলামী ইতিহাসবিদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, ইমাম হুসাইনের শির কায়রোতে পৌঁছাবে বলে খবর পাওয়ার পর সেখানকার বাসিন্দারা সেই রকম আনন্দোৎসব করেছিলেন, যেমন আনন্দোৎসব করেছিলেন হেজাজের বাসিন্দারা – যখন মোহাম্মদের নবুওয়ত প্রাপ্তির লক্ষণগুলি প্রকাশ পেয়েছিল।
হেজাজ বলতে লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী একটি অঞ্চলকে বোঝায়, যা সৌদি আরবের সবচেয়ে জনবহুল এলাকাগুলির মধ্যে অন্যতম। ইসলামের জন্য পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা এ অঞ্চলেই অবস্থিত।
মৌলিদ অর্থাৎ ইমাম হুসাইনের জন্মদিনটি হুসাইনি মসজিদের ভেতরে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হয়।
সেদিন দিনভর কোরান তেলাওয়াত, হাদিসের তরজমা আসর, নবী মোহাম্মদ ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলাদা সেশন হয়। এছাড়াও ওইদিন সেখানে হামদ ও নাতেরও আয়োজন করা হয়।
ড. মোমিন আল-খালিজি বলেছেন, সেসময় কয়েকদিন ধরে মসজিদে নবী মোহাম্মদের প্রশংসাসূচক গান নাত পরিবেশন এবং মিষ্টি বিতরণ চলতে থাকে।
শাবান মাসে ইমাম হুসাইনের আসল জন্মদিনেও এই একই ধরনের আয়োজন হয়।
তবে, রাবি-উস-সানি মাসের শেষে ইমাম হুসাইনের শির কায়রো পৌঁছানোর দিনে বিপুল জনসমাগম হয় সেখানে।

‘তার পবিত্র মুখ মিসরকে আলোকিত করেছে’
“হুসাইনের জন্য ভালোবাসা সৌভাগ্যের বাহক,
তার নূর ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে।
শেষ নবীর দৌহিত্র, যার মাধ্যমে এ মহান বংশের ইতি ঘটেছে।
তার পবিত্র মুখ আলোকিত করেছে পুরো মিসরকে।”
এগুলো বিখ্যাত ক্বারি ও মোনাজাত-কারী শেখ তাহা আল-ফাশনি, যিনি সত্তরের দশকের শুরুর দিকে মারা গেছেন, তার আবৃত্তি করা পঙতিসমূহ।
এসব পঙতিমালার মাধ্যমে বোঝা যায় মিশরীয়রা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের নবীর প্রিয় নাতি ইমাম হুসাইনের মাথা মিশরের মাটিতেই সমাহিত করা হয়েছে।
তবে, মিশরের কিছু মানুষ, বিশেষ করে যারা সালাফি মতবিশ্বাসের সাথে যুক্ত, তারা এ রীতি বা বিশ্বাসকে স্বীকার করেন না।
এখানে উল্লেখ্য, ইতিহাসবিদরা এ বিষয়টিতে একমত যে, ইরাকে কারবালার যুদ্ধের পর শির ছাড়া ইমাম হুসাইনের দেহাবশেষ ৬১ হিজরির ১০ই মুহররম (১০ই অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ‘উৎবাহ হুসাইনিয়া’তে সমাহিত করা হয়েছিল।
তবে, হুসাইনের শির কোথায় সমাহিত হয়েছিল তা নিয়ে মত ভিন্নতা রয়েছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, কারবালার ঘটনার পর, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার অধীনে ইরাকের গভর্নর ইবনে জিয়াদের সৈন্যরা ইমাম হুসাইনের শির ইরাকের বিভিন্ন শহর ঘুরিয়ে সিরিয়ায় নিয়ে যায়।
কিছু বর্ণনায় জানা যায়, ইমাম হুসাইনের মাথা চল্লিশতম দিনে কারবালায় তার বাকি দেহাবশেষের সাথেই পাওয়া যায়।
হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শিয়া জুরি এবং হাদিস বিশারদ শরীফ আল-মুর্তাদা, হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর ইবনে আল-ফাতাল আল-নিসাবুরি এবং হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীর হাদিস বিশারদ সাইয়্যিদ ইবনে তাউস – তাদের বর্ণনাতেও এ তথ্য পাওয়া যায়।
আবার কিছু বর্ণনায় জানা যায়, ইমাম হুসাইনের মাথা মদীনায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং তার মা ফাতিমা আল-জাহরার কাছে আল-বাক্বীতে দাফন করা হয়েছিল – হিজরি দ্বিতীয় শতকের ইতিহাসবিদ ইবনে সা’দ, সপ্তম শতকের আল-তাবাকাত আল-কুবরা এবং হিজরি অষ্টম শতকের ইবনে তাইমিয়ার লেখা বইয়ে এমন তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।

আরো কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সময়েই ইমাম হুসাইনের শির সিরিয়ার দামেস্কের রাজকীয় অস্ত্রগারের পাশে দাফন করা হয়েছিল এবং বলা হয়ে থাকে সে জায়গাটির অবস্থান দামেস্কের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক ফটক ‘বাব আল-ফারাদিস’ এ।
ইতিহাসবিদ ইবনে কাঠির তার বই আল-বিদা’ওয়া আল নাহা নামক গ্রন্থে এ তথ্য উল্লেখ করেছেন।
তবে, মিসরে বহুল প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, ইমাম হুসাইনের কাটা মস্তক দামেস্ক, যেখানে খলিফা উমরের প্রাসাদ ছিল, সেখান থেকে ফিলিস্তিনি শহর আশকেলনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
‘হুসাইনের শির নিয়ে যা বলছে প্রাচীনতম হস্তলিপি’
বিবিসি বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাথে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছিল যে, ইমাম হুসাইনের শির আশকেলন থেকে মিসরে পাঠানো নিয়ে ‘প্রাচীন হস্তলিপি’তে ঠিক কী বলা আছে।
ইতিহাসবিদ আহমাদ ইবনে ইউসুফ ইবনে আলি, যিনি ইবনে আল-আযরাক আল-ফারকি নামে পরিচিত, তিনি তুরস্কের বিখ্যাত শহর মিয়াফারাকিন – বর্তমানে যা দিয়ারবাকির নামে পরিচিত, সেখানকার এক সম্ভ্রান্ত বংশের সদস্য এবং একজন বিচারক।
আল-ফারকির দাদার সাথে সেসময়কার রাজকীয়, উচ্চ-বংশীয়, এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের যোগাযোগ ছিল, এবং ইবনে আল-আযরাক নিজে প্রচুর ভ্রমণ করতেন – বিশেষ করে ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী মানুষদের মাজার ও কবরস্থানে ঘুরেছেন।
তিনি বাগদাদে তিনবার সফর করেছেন, দেখা করে কথা বলেছেন খলিফা, মন্ত্রী এবং বিচারকদের সাথে। সাথে স্থানীয় পন্ডিত ব্যক্তিদের সাথে দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন। তিনি দামেস্ক এবং অন্য দেশেও সফর করেছেন।
ইবনে আল-আযরাক তার লেখা বই তারিখ-ই-মিয়াফারাকিন এ ঐতিহাসিক ঘটনার দুইটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই বইটির একটি ফটোকপি বিবিসির কাছে রয়েছে।
প্রথম বিবরণে বলা হয়েছে, আশকেলনের থেকে মানুষজন দামেস্কে এসে ইমাম হুসাইনের শির দাবি করলে, সেটি তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তারা সেটি আশকেলনে নিয়ে যান এবং সেখানে বিপুল অর্থ ব্যয় করে একটি বড় মাজার তৈরি করেন।

ইরাক সম্পর্কে লেখা তার বইয়ের ‘ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার শাসন এবং ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ড’ শীর্ষক অধ্যায়ে পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিবরণ, যেখানে বলা হয়েছে, ইমাম হুসাইনের শির কারবালাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং শরীরের সাখে সেখানেই দাফন করা হয়েছিল।
ইবনে আল-আযরাক লিখেছেন, ইমামের শির হিজরি ৫৪৯ সন পর্যন্ত আশকেলনে রাখা হয়েছিল।
এরপর ক্রুসেডাররা আশকেলনে হামলা চালালে খলিফা জাফর ইমাম হুসাইনের মস্তক একটি বাক্সে ভরে, নিজের বুকে করে বয়ে মিসরে নিয়ে যান। সেখানে বিপুল অর্থ ব্যর্থ করে তিনি একটি বড় মাজার নির্মাণ করেন।
তিনি আরো লিখেছেন, ক্রুসেডাররা আশকেলন দখল করে নেয়ার তিনদিন আগে আশকেলনের মসজিদটিতে থাকা স্বর্ণ, রূপা, তৈজসপত্র, কার্পেট, পর্দা – সব কিছু মিসরের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ইবনে আল-আযরাকের হস্তলিপির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম, কারণ তিনি ওই সময়কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি নিজে হিজরি ৫১০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছেন।
ব্রিটিশ লাইব্রেরির তথ্য অনুযায়ী, ইবনে আল-আযরাক হিজরি ৫৭২ সনে তার বইটি লিখেছেন, অর্থাৎ ইমাম হুসাইনের শির সমাহিত করার ২০ বছরের মধ্যে লেখা হয়েছে সেটি। এর মানে হচ্ছে সময়ের দিক থেকে সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ে লেখা হস্তলিপি হচ্ছে ইবনে আল-আযরাকের হস্তলিপি।
হিজরি নবম শতকে মিসরীয় ইতিহাসবিদ ইবনে আয়াস লিখেছেন, “সায়িদ আল-হুসাইনের শির যখন আশকেলন থেকে কায়রোতে আনা হয়, সেটি চামড়ার মুড়ানো একটি বাক্সের ভেতরে ছিল।”
ইতিহাসবিদ আল-মাকরিযি লিখেছেন, “ইমামের শির যখন আশকেলন থেকে আনা হয়, তখনো এর রক্ত শুকিয়ে যায়নি, এবং শিরটি থেকে সুবাস আসছিলো। সেটি নীল নদে শস্য পরিবহন করা হয় এমন বিশেষ নৌকা ‘আসারি’তে করে বুস্তানের ‘কাফুরি’ উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়।”
আল-মাকরিযি লিখেছেন, এরপর ইমামের শির “একটি বিশেষ বাক্সে করে কাসর আল-জুমার্দ প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং পরে এখনকার যে মাজার তার প্রধান ফটকের কাছে সমাহিত করা হয়। মাজারে ঢোকার মুখে সবাইকে কবরের সামনের ভূমি চুম্বন করে ঢুকতে হয়।”

‘হুসাইন আমাদের মিসরীয় সংস্কৃতির অংশ’
ঐতিহাসিক বর্ণনা ও প্রমাণের বাইরে, ইমাম হুসাইনের নাম এবং বিভিন্ন স্মারক নানাভাবে মিসরীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
মিসরে বিভিন্ন সময়ে লেখা জনপ্রিয় বহু সঙ্গীত, নবী মোহাম্মদের প্রশংসাসূচক গান নাত, এবং বিখ্যাত আলেম শেইখ আল-নকশবান্দি এবং শেইখ তাহা আল-ফাসনির মোনাজাতেও ইমাম হুসাইনের নাম সংযুক্ত করা হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে লেখা কবিতা, সিনেমা এবং উপন্যাসেও ইমাম হুসাইনের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মিসরীয়রা ইমাম হুসাইনের জন্মদিন কীভাবে পালন করেন? এই কৌতূহল থেকে আয়ারল্যান্ড থেকে মিসরে ছুটি কাটাতে আসা আমার খ্রিষ্টান বন্ধু মারিয়ান ফেরত যাবার আগে ইমাম হুসাইনের মাজারে যেতে চেয়েছিলো।
তার মাথায় হিজাব বা মাথা ঢাকার কিছু ছিল না, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে তাকে কেউ বাধা দিলো না। ও যতক্ষণ সেখানে দাড়িয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছিলো, কেউ তার দিকে মনোযোগই দেয়নি।
এই পরিদর্শনের অনেকদিন পরে মারিয়ান আমাকে বলেছিল, মাজারে ঢুকে সে কী দেখেছিল?
“আমি যখন ঢুকলাম, আমার মনে হলো আমি আগে যেমন ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ দেখতে পেলাম। আমি দেখেছি নিরাশায় ভঙ্গুর মানুষ আশা আর বিশ্বাস নিয়ে এসেছেন। অসীম ভক্তি নিয়ে এসেছেন কেউ কেউ, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আল্লাহকে ডাকছেন তারা। এবং মনে হচ্ছিল যেন সৃষ্টিকর্তা তাদের আকুতি শুনতে পাচ্ছেন।”
একজন মিসরীয় ধর্মযাজক ফাদার দোমাদিস বলছিলেন, “ইমাম হুসাইনের আত্মা মানবজাতিকে স্বার্থহীনতা, দান এবং ত্যাগের শক্তি দিয়েছেন এবং নিজের রক্ত দিয়ে তিনি মানবতার গৌরব লিখে গেছেন।”

‘মাতামহের ধর্মের প্রচারের জন্য জীবন উৎসর্গ’
নাওয়ারা নাজম বিবিসিকে বলেছেন, দর্শনার্থীরা যখন ইমাম হুসাইনের মাজারে প্রবেশ করেন, তারা তাকে ‘হে শহীদ’ বলে সম্বোধন করেন, কারণ স্বাভাবিকভাবেই মিশরীয়রা শহীদদের অপরিসীম শ্রদ্ধা করেন।
তাদের কাছে, এটি নিজের জীবন এবং যৌবন উৎসর্গ করে ত্যাগের বীরত্বপূর্ণ গল্পের ধারাবাহিকতাই যেন – যার শুরু হয়েছে প্রাচীন মিশরীয়দের ওসিরিসের গল্প থেকে, ক্রমে যুক্ত হয়েছে যীশু খ্রিষ্টের আত্মত্যাগ, আর শেষ হয়েছে ইমাম হুসাইনের আত্মদানের গল্পের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন যে, মিশরীয় আখ্যান অনুযায়ী, ইমাম হুসাইন ‘আধ্যাত্মিক শক্তি’ ধারণ করেছিলেন, যা তাকে দুর্বলরা যা সহ্য করতে পারে না তা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছিল, যা অন্যদের জন্য স্বস্তি ও সুখ আনতে পারে।
মিশরীয়রা ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগকে তার ‘মাতামহ বা নানার ধর্মের প্রচারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ’ হিসাবে বর্ণনা করেন।
নাওয়ারা ইমাম হুসাইনকে প্রান্তিক, দরিদ্র এবং অভাবী মানুষদের ‘নায়ক’ হিসাবে বর্ণনা করেন, যাদের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
নাওয়ারা বলেছেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ড একটি বেদনাদায়ক ঘটনা হলেও, মিসরীয়দের মনে তাকে স্মরণের বিষয়টি বিষাদের নয়, বরং সেটি আনন্দের।
নাওয়ারা বলেছেন, তিনি যখনই ইমাম হুসাইনের কথা বলেন তার মুখ হাসিতে ভরে যায়।
শিরিনেরও একই ধরনের অনুভূতি হয় এবং যারা বিশ্বাস করে শরিয়া আইন অনুযায়ী কবর জিয়ারতের বিধান নেই – তাদের তিনি পাত্তাও দেন না।
তিনি বলছেন, আপনি যখন নবী মোহাম্মদের পরিবারের কারো কবর জিয়ারত করেন, আপনার মুখভঙ্গিই বদলে যায় এবং মুখে এক ধরনের আলো চলে আসে।
মিসরীয় নারীদের বেশিরভাগেরই এই ধরনের অনুভূতি , যারা ইমাম হুসাইনের মাজারে এসেছেন।

‘আমাদের রক্ষাকর্তা’
“আপনি এক মহান ভালোবাসা, আপনি প্রথম ও শেষ, এবং আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। ও আমার প্রিয়তম, আপনার প্রেমে আমার অন্তর পূর্ণ।”
এটি বিখ্যাত মিসরীয় সঙ্গীত শিল্পী রাগিব আলমের একটি গানের কথা। নাওয়ারা বলছেন, ইমাম হুসাইনের মাযারে কাফেলা করে যাওয়া নারীপুরুষের একটি দলকে কিছুদিন আগেই এই গান গাইতে গাইতে যেতে দেখেছেন তিনি।
ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগ, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া তাকে বীরের আসন দিয়েছে মিসরীদের মনে।
ইমাম হুসাইনকে ‘রাইস জুমহুরিহি আল-বাতিন’ বা মিসরের আধ্যাত্মিক শাসক এবং ‘ওয়ালি আল-নাম’ অর্থাৎ যিনি মঙ্গল, আশীর্বাদ এবং আশার আলো আনা মহাপুরুষ হিসেবে দেখা হয়।
ইমাম হুসাইনের প্রতি মিসরীয় অনভূতি অনেকটাই বংশ পরম্পরায় চলে আসার মতো ব্যাপার।
নাওয়ারা বলছেন, ইমাম হুসাইনের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটি তিনি তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। এখন তিনি নিজের কন্যাকে তার গল্প বলেন এবং ইমামকে ভালোবাসতে উৎসাহিত করেন।
হুসাইনি মসজিদের ইমাম ড. মোমিন বলছিলেন, ইমাম হুসাইনকে ভালোবাসা আরো বিশেষ এই কারণে যে তার নানা ইসলামে শেষ নবী মোহাম্মদ তার এই দৌহিত্রকে খুবই ভালোবাসতেন এবং তিনি বলেছেন, ‘যে হুসাইনকে ভালোবাসে, সে আল্লাহকে ভালোবাসে।’
মিসরীয় সমাজকে ঘনিষ্ঠভাবে যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারা জানেন গত ৮০০ বছর ধরে দেশটির অধিবাসীরা ইমাম হুসাইনকে ভালোবেসে আসছেন।
ভালোবেসে নানা নামে তারা ইমাম হুসাইনকে সম্বোধন করেন, তার শির রক্ষিত আছে এমন স্থানকে তারা পবিত্র বলে জ্ঞান করেন। যেখানে মানুষ শান্তি, আশীর্বাদ আর সুখের খোঁজে যান, এবং মাজারে যাওয়ার কারণে কোনো ধর্মীয় বিতর্ক তৈরি হবে কি-না তা পরোয়া করেন না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















