উদ্বোধনের জৌলুসে আশার আলো
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত রাজধানী ফনমপেনের নতুন তেচো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট উদ্বোধনকালে ঘোষণা দিয়েছিলেন—এই প্রকল্প দেশের পর্যটন ও বিনিয়োগে নতুন গতি আনবে। প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই বিমানবন্দরটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ফস্টার + পার্টনার্সের নকশায় এবং চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের নির্মাণে তৈরি হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে এর বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা ১ কোটি ৫০ লাখ, যা ২০৩০ সালে দ্বিগুণ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫ কোটি পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালে সিয়েম রিয়াপে আংকর ওয়াত মন্দিরকেন্দ্রিক এলাকায় ৭০ লাখ যাত্রী ধারণক্ষমতার একটি বিমানবন্দর চালু হয়েছিল।
উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে কঠিন বাস্তবতা
তবে এই উচ্চাশা এখন কঠিন বাস্তবতার মুখে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পর্যটন খাত কম্বোডিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯.৪ শতাংশ অবদান রাখলেও ২০২৫ সালে তা ধাক্কা খাচ্ছে প্রতারণা চক্র, মানবপাচার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে।
২০২৪ সালে দেশটিতে বিদেশি পর্যটক এসেছিল ৬৭ লাখ, যা ২০১৫ সালের ৪৭ লাখ থেকে অনেক বেশি। ২০২৫ সালে লক্ষ্য ছিল ৭৫ লাখ, কিন্তু বছরের প্রথম আট মাসে আগমন মাত্র ৪.০৫ মিলিয়ন—গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬ শতাংশ কম।
বিশেষ করে থাইল্যান্ডের সঙ্গে জুলাইয়ের সংঘর্ষের পর আগস্ট মাসে পর্যটক সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৩৮.৪ শতাংশ কমে যায়।

থাই পর্যটকদের বড় পতন
প্রথাগতভাবে থাই নাগরিকরাই কম্বোডিয়ার সবচেয়ে বড় পর্যটকগোষ্ঠী। কিন্তু ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে তাদের আগমন ২৮.২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬২ হাজারে—গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ১৩ লাখ ৪০ হাজার। দুই দেশের সীমান্ত এখনও বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
প্রতারণা কেন্দ্রের আতঙ্কে পর্যটন সংকট
কম্বোডিয়া ট্যুরিজম ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি টাচ কোসাল জানান, প্রতারণা ও মানবপাচার কেন্দ্রের ভয়ই এখন সবচেয়ে বড় বাধা।
তার মতে, “যখন বিদেশি গণমাধ্যমে এসব অনলাইন স্ক্যাম বা অপহরণের খবর প্রচার হয়, তখন পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা দেশটিকে এড়িয়ে চলে।”
এই মাসের শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়া এক নাগরিককে প্রতারণা কেন্দ্রের হাতে নির্যাতনে নিহত হওয়ার ঘটনার পর কয়েকটি অঞ্চলে “কোড ব্ল্যাক” ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে (যদিও সিয়েম রিয়াপ ও ফনমপেনের আওতায় নয়)।
ভারতও তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
সিয়েম রিয়াপের এক ট্যুর অপারেটর বলেন, “মানুষ এখানে নিরাপদে আনন্দ করতে আসে। কিন্তু যখন শুনছে প্রতারণা ও অপহরণের কথা, তখন কে আসবে? জুন মাসের পর থেকে আমার গ্রাহক অর্ধেকে নেমে গেছে।”
শিল্প সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) কম্বোডিয়া অধ্যায়ের চেয়ারম্যান থর্ন সিনান বলেন, “অনলাইন প্রতারণা এখন পর্যটন খাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উদ্বেগ প্রকাশ করছে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি কোথায় যাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।”

সরকারের দমন অভিযান ও সীমিত সাফল্য
দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিম জিনা’র সঙ্গে বৈঠকে কম্বোডিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সার সোখা জানান, সরকার নিয়মিত অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার, বিচার ও বিদেশি অপরাধীদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।
২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে সরকার ৪৮টি অনলাইন জালিয়াতি মামলায় ১৬৮ জনকে আটক করেছে এবং ২,৭২২ জন বিদেশিকে বহিষ্কার করেছে। এছাড়া ১৪৭টি মানবপাচার মামলায় ২০৫ জনকে গ্রেপ্তার ও ৪৮৩ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
তবুও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তিকে—যেমন শাসকদলের সিনেটর লাই ইয়ং ফাট ও প্রিন্স গ্রুপের প্রধান চেন ঝি—নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে, কম্বোডিয়া এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিদেশি পর্যটকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
এক হংকং নাগরিক জাস্টিন লাউ বলেন, “আমার পরিবার আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু আমি জানাই যে এসব কেবল কিছু অঞ্চলে ঘটে, গোটা দেশে নয়।” তিনি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সিহানুকভিল শহরে যাওয়া এড়িয়ে চলেন।
তুরস্কের নাগরিক বারখর বাসদাল বলেন, “আমি খুব ভীত নই, তবে কথা বলার সময় বা কারও সঙ্গে যোগাযোগের আগে এখন একটু বেশি সতর্ক থাকি।”

সরকার পরিস্থিতির দায় দিচ্ছে সীমান্ত সংঘর্ষে
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কুচ পানহাসা দাবি করেন, পর্যটকের সংখ্যা কমার কারণ অনলাইন প্রতারণা নয়, বরং থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত অচলাবস্থার কারণে।
তার ভাষায়, “থাইল্যান্ডের আগ্রাসনে সীমান্তে যাতায়াত ব্যাহত হয়েছে এবং অনেক ট্যুর বাতিল হয়েছে। এজন্যই সামান্য হ্রাস দেখা যাচ্ছে।”
#কম্বোডিয়া,# তেচো_#এয়ারপোর্ট, #পর্যটন_সংকট
Sarakhon Report 


















