ফেডারেল সরকারের চলমান শাটডাউনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে স্থগিত হয়ে গেছে ৬০ বছরের পুরোনো খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি ‘ফুড স্ট্যাম্প’। প্রায় ৪১ মিলিয়ন নিম্নআয়ের আমেরিকান এখন অনিশ্চয়তার মুখে, কারণ অধিকাংশ রাজ্যই জানিয়েছে— তারা নিজস্ব বাজেট থেকে এই বিপুল সহায়তার শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না।
বেঁচে থাকার ভরসা এখন অনিশ্চিত
টেনেসির চাটানুগা শহরের ৬০ বছর বয়সী রোমা হ্যামন্ডস পাঁচ বছর আগে নাতি-নাতনির অভিভাবকত্ব পাওয়ার পর থেকে “ফুড স্ট্যাম্প” বা খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির ওপর নির্ভরশীল। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কাজ করতে পারেন না এমন হ্যামন্ডস প্রতি মাসে ৫৬৩ ডলারের ফেডারেল সহায়তায় পরিবার চালিয়ে আসছিলেন।
কিন্তু নভেম্বরে সেই অর্থ হয়তো আর পাবেন না, কারণ ফেডারেল সরকারের চলমান অচলাবস্থা বা শাটডাউনের কারণে এই সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। টেনেসি রাজ্যও জানিয়েছে— তারা নিজেরা এই ব্যয় বহন করতে পারবে না।
“আমি জানি না এখন কী করব।” বললেন হ্যামন্ডস।
৬০ বছরের পুরোনো সহায়তা কর্মসূচি বড় বিপর্যয়ে
হ্যামন্ডস একা নন। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রায় ৪১ মিলিয়ন মানুষ এই ‘সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম’ (SNAP)-এর সুবিধাভোগী, যা মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পাঠায় নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে।
তবে এখন পর্যন্ত কংগ্রেস কিংবা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন— কেউই নভেম্বরে এই সুবিধার অর্থায়নে পদক্ষেপ নিতে পারেনি। শুক্রবার দুই ফেডারেল বিচারক রায় দিয়েছেন, প্রশাসন নভেম্বরের সুবিধা বন্ধ করতে পারবে না এবং USDA, কৃষি দপ্তর, তাদের ৫ বিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিল ব্যবহার করে এই অর্থ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।
কৃষি দপ্তর এখনো জানায়নি তারা কীভাবে রায়টি কার্যকর করবে বা নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা।
মাত্র পাঁচটি রাজ্যের সীমিত সহায়তা
রয়টার্সের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ডেলাওয়্যার, নিউ মেক্সিকো, লুইজিয়ানা, ভার্জিনিয়া, ভারমন্ট এবং ডিসট্রিক্ট অব কলম্বিয়া — এই পাঁচটি রাজ্য ও অঞ্চল নভেম্বরে আংশিক বা পূর্ণ সহায়তা চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে, অধিকাংশ রাজ্য জানিয়েছে তারা প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে এই সহায়তা চালাতে পারবে না। USDA এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কোনো রাজ্য নিজেরা অর্থ ব্যয় করলে সেই খরচ পরবর্তীতে ফেরত দেওয়া হবে না।

রাজ্যগুলোর বাজেট সংকট ও প্রশাসনিক জটিলতা
বেশিরভাগ রাজ্য বার্ষিক বা দুই বছর অন্তর বাজেট তৈরি করে। ফলে ফেডারেল সহায়তা বন্ধ হলে তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পিউ চ্যারিটেবল ট্রাস্টসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তায় ফেডারেল অনিশ্চয়তা রাজ্য অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।
এম্পাওয়ার মিসৌরির খাদ্য নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক কর্মকর্তা ক্রিস্টিন উডি বলেন, “প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। এই মুহূর্তে ১৩০ মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে আনব?”
USDA বলেছে, “এই শাটডাউন সিনেট ডেমোক্র্যাটদের জন্য এক সংকটময় মুহূর্ত।” সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, ডেমোক্র্যাটরা ব্যয়ের বিল পাসে ভোট দিচ্ছে না বলে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে।
বিশাল অঙ্কের ঘাটতি
USDA-র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে রাজ্যভেদে SNAP সহায়তার পরিমাণ ৪.৯ মিলিয়ন ডলার (ওয়াইওমিং) থেকে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি (ক্যালিফোর্নিয়া) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এই অর্থ বিতরণের জন্য রাজ্যগুলো বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে যারা সুবিধাভোগীদের ইলেকট্রনিক কার্ডে অর্থ যুক্ত করে দেয়। কিন্তু অনেক রাজ্য জানিয়েছে— নিজেদের উদ্যোগে সেই কার্ডে অর্থ যোগ করার প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা তাদের নেই।

টেনেসির গভর্নর বিল লি এক বিবৃতিতে বলেন, “রাজ্যের নিজস্ব তহবিল থেকে এই অর্থ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ কার্ডে অর্থ যোগ করার কোনো ব্যবস্থা নেই।”
ম্যাসাচুসেটস সরকার জানায়, “SNAP কর্মসূচি প্রতি মাসে ২১০ মিলিয়ন ডলার ফেডারেল সহায়তা আনে; এক মাসের ঘাটতিও রাজ্য বাজেট বহন করতে পারবে না।”
কয়েকটি রাজ্যের বিকল্প উদ্যোগ
ভার্জিনিয়া তার বাজেট উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে অন্তত নভেম্বর পর্যন্ত সাপ্তাহিক সহায়তা চালু রাখবে বলে জানিয়েছে। ডেলাওয়্যারও সপ্তাহভিত্তিক অর্থায়ন অব্যাহত রাখবে। লুইজিয়ানা, ভারমন্ট ও নিউ মেক্সিকো আংশিক সহায়তার ব্যবস্থা করছে।
অন্যদিকে কানেকটিকাট, নিউ মেক্সিকো ও ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অতিরিক্ত অর্থ পাঠাচ্ছে খাদ্যব্যাংকগুলোতে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান আগেই চরম চাপের মুখে রয়েছে এবং তারা বলছে— চাহিদা বেড়ে গেলে তা সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অনেক রাজ্য নাগরিকদের আহ্বান জানিয়েছে— যেন তারা অগ্রিম পরিকল্পনা নেয়, খাদ্যব্যাংকে যায়, এবং যাদের সামর্থ্য আছে তারা সময় ও অর্থ দান করে।
আর্কানসাসের মানবসেবা দপ্তর বলেছে, “চলুন সবাই মিলে এমন কিছু করি যাতে কোনো পরিবার অনাহারে না থাকে।”

রাজনৈতিক দায়-দায়িত্বের লড়াই
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দোষারোপও তীব্রতর হয়েছে।
ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন কিছু রাজ্য ট্রাম্প প্রশাসনকে দায়ী করছে, আবার রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন কিছু রাজ্য দোষ দিচ্ছে কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের।
উত্তর ক্যারোলিনার গভর্নর জশ স্টেইন (ডেমোক্র্যাট) বলেন, “সরকারের হাতে জরুরি তহবিল থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করা নির্মম ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।”
অন্যদিকে লুইজিয়ানার গভর্নর জেফ ল্যান্ড্রি (রিপাবলিকান) এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের সিনেটররা বারবার সরকার পুনরায় চালু করতে ভোট দিয়েছেন। এখন সময় এসেছে ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন সিনেটও হ্যাঁ ভোট দেওয়ার।”
তবে এখন পর্যন্ত সরকার পুনরায় চালুর জন্য ১৩টি ভোট ব্যর্থ হয়েছে।
৬০ বছরের পুরোনো এই খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোর একটি। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা, বাজেট ঘাটতি এবং প্রশাসনিক জটিলতা মিলিয়ে কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা এখন অনিশ্চয়তার মুখে।
#খাদ্যসহায়তা #আমেরিকা #ফেডারেলশাটডাউন #SNAP #দারিদ্র্য #রাজনৈতিকসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 














