ট্রাম্পের পাঁচ দিনের সফর: বাণিজ্য ও কূটনীতির মিশ্র বার্তা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়া সফর শেষে পাঁচ দিনের এশিয়া সফর শেষ করেন। সফরে তিনি মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বৈঠক করেন, যেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা।
ট্রাম্পের সফর বরাবরের মতো ‘চুক্তি-কেন্দ্রিক’ ছিল— যেখানে প্রতিটি দেশ নিজেদের জন্য সুবিধা আদায়ের পাশাপাশি ওয়াশিংটনের শুল্কনীতির প্রভাব মোকাবিলায় তৎপর ছিল।
শান্তির দূত হিসেবে ট্রাম্প
সফরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, যার কৃতিত্ব ট্রাম্প নিজে দাবি করেন। মালয়েশিয়ায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা শুধু একটি চুক্তি নয়, লাখো প্রাণ বাঁচিয়েছি।”
যদিও দুই দেশ জুলাই মাসেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল, তবু, এই নতুন চুক্তি তাদের সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়।
ট্রাম্প বলেন, “আমার প্রশাসন আট মাসে আটটি যুদ্ধ শেষ করেছে— যা গলফ খেলার চেয়ে অনেক আনন্দের।”

তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ এখনো অমীমাংসিত। আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দেশটির ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যেখানে সামরিক সরকারের অধীনে ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এশীয় দেশগুলোর জন্য কঠিন বাণিজ্য ভারসাম্য
মালয়েশিয়া ১,৭১১টি পণ্যের ওপর শুল্কছাড় পেলেও, যা তাদের মোট রপ্তানির ১২ শতাংশ, দেশটির সংসদ সদস্যরা এই চুক্তিকে ‘অর্থনৈতিক আত্মসমর্পণ’ বলে সমালোচনা করেছেন। একই রকম সমালোচনা উঠেছে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামেও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও কৃষি পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে যথাক্রমে ৫৫০ বিলিয়ন ও ৩৫০ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করতে হবে। এই বিনিয়োগ কোথায় হবে, সেটি নির্ধারণ করবেন ট্রাম্প নিজেই। সিউলে শত শত বিক্ষোভকারী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
অন্যদিকে, চীন ফেন্টানিল-সম্পর্কিত পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামাতে সক্ষম হয়। তবে অন্যান্য শুল্ক অপরিবর্তিত থাকায়, চীনা পণ্যের গড় শুল্কহার প্রায় ৪৭ শতাংশে রয়ে গেছে— যা রপ্তানিকারকদের জন্য এখনো বড় একটি বোঝা।
বিরল খনিজ নিয়ে নতুন কৌশল
সফরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল জাপান, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিরল খনিজ ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহ শৃঙ্খলা নিয়ে সহযোগিতা চুক্তি। এর আগে ট্রাম্প অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও একই ধরনের সমঝোতা করেছিলেন।
মালয়েশিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে এসব খনিজ রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা কোটারোপ করবে না।
এই চুক্তিগুলো আসে এমন সময়, যখন চীন বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে— যা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে সামরিক অস্ত্র পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনীতিবিদ জুলিয়ান ইভানস-প্রিচার্ড বলেন, “চীনের নিয়ন্ত্রণের পরই বিকল্প উৎস তৈরির তাগিদ দেখা দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তিগুলো সেই প্রচেষ্টাকেই এগিয়ে নেবে।”

নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক
জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে ট্রাম্পের প্রথম সাক্ষাৎেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তাকাইচি ট্রাম্পকে আবের ব্যবহৃত একটি গলফ পাটার উপহার দেন। ট্রাম্প তাকাইচিকে “ঘনিষ্ঠ বন্ধু” বলে অভিহিত করেন।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে সক্ষম হন। ট্রাম্প নিরাপত্তা বিধি অমান্য করে আনোয়ারকে প্রেসিডেন্টের গাড়িতে একসঙ্গে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আনোয়ার মজা করে বলেন, “আমরা দুজনই কারাগারের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছি— শুধু একজন প্রবেশ করেছে, অন্যজন প্রায়ই যাচ্ছিল।”
তবে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে প্রতিশ্রুত সাক্ষাৎ হয়নি। ট্রাম্প বলেন, সময়ের অভাবে বৈঠক সম্ভব হয়নি, তবে ভবিষ্যতে তিনি সাক্ষাতের ইচ্ছা রাখেন। কিম কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি; বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট এশিয়া সফরে থাকাকালীন উত্তর কোরিয়া নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক: সাময়িক শান্তি, স্থায়ী সন্দেহ
বুসানে ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের বৈঠক একটি বছরের জন্য বাণিজ্য বিরতি আনতে পারে, যেখানে নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কোনো স্থায়ী সমঝোতা নয়।
বিএনপি প্যারিবাসের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রধান বিশ্লেষক উইলিয়াম ব্রাটন লিখেছেন, “এই চুক্তিগুলো শুধু বর্তমান সমস্যাগুলো সাময়িকভাবে প্রশমিত করবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মৌলিক বিভাজন দূর করবে না।”
ট্রাম্পের এই সফরে আসিয়ানও ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্য বজায় রেখে একসঙ্গে চীন-আসিয়ান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির উন্নত সংস্করণেও সই করেছে।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জা ইয়ান চং বলেন, “ট্রাম্প প্রায়ই প্রতিশ্রুতি দেন এবং পরে মত বদলান, তাই আসিয়ান দেশগুলো সতর্কই রয়েছে।”

বিশ্লেষণ: চুক্তির ঝড়ে আঞ্চলিক অনিশ্চয়তা
ট্রাম্পের এই সফর একদিকে কূটনৈতিক সাফল্যের বার্তা দিয়েছে, অন্যদিকে নতুন সন্দেহও জাগিয়েছে। কিছু দেশ বাণিজ্যিক ছাড় পেলেও শুল্কনীতি ও বিনিয়োগের চাপে তাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্র এখনো ‘অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ নীতিতে অটল।
ট্রাম্প এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়তে সফল হলেও, আঞ্চলিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কতটা টেকসই হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
#ট্রাম্প #এশিয়া_সফর #বাণিজ্য_চুক্তি #আসিয়ান #চীন_মার্কিন_সম্পর্ক #বিরল_খনিজ #আন্তর্জাতিক_কূটনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















