সুরাজ মিলিন্দ ইয়েংদে’র বই ‘কাস্ট: আ গ্লোবাল স্টোরি’ প্রমাণ করে যে জাতপাত কেবল ভারতের ভেতরের সামাজিক বাস্তবতা নয়। উপনিবেশ, অভিবাসন ও বিশ্বায়নের জগতে এটি নানা ভূগোল ও সংস্কৃতিতে নতুন রূপে টিকে আছে। ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান ও আর্কাইভ-ভিত্তিক এই গবেষণাকর্ম প্রবাসী দলিত আন্দোলন, কৃষ্ণাঙ্গ-দলিত সম্পর্ক, ঔপনিবেশিক শ্রেণিবিন্যাস ও ‘দলিত ফিউচারিজম’-এর ধারণাকে একত্রে যুক্ত করে বৈশ্বিক পরিসরে জাতপাতের কাঠামো ও প্রভাব বোঝার নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়।
জাতপাতের বৈশ্বিক বিস্তার
- জাতপাত শুধুমাত্র ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা নয়;উপনিবেশবাদ, শ্রম-অভিবাসন ও প্রবাসী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এটি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
• অর্থনীতি, ধর্মীয় আখ্যান, সামাজিক পুঁজি ও সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে এটি নতুনভাবে নির্মিত ও পুনর্গঠিত হয়েছে।
• ফলে জাতপাত বুঝতে হলে দেশের বাইরের ইতিহাস, সাহিত্য ও প্রবাসী জীবনের অধ্যয়নও সমান জরুরি।
১৯৮২: ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর ও প্রবাসী প্রতিবাদ
- ১৯৮২ সালের জুলাইয়ে ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর প্রবাসী সংগঠনVISION (Volunteers in Service to India’s Oppressed and Neglected)-এর প্রতিবাদের কারণে আলোচনায় আসে।
• সংগঠনের প্রধান লক্ষ্মী নারায়ণ বেওয়াকে মার্কিন রাজনীতিবিদ পল সারবানিস ও চার্লস ম্যাথিয়াস জুনিয়র আশ্বস্ত করেন যে তাঁরা দলিত নির্যাতনের বিষয়টি কংগ্রেসে তুলবেন।
• ইন্দিরা গান্ধীর সংক্ষিপ্ত জবাবে সরকারের পদক্ষেপের কথা বলা হলেও প্রবাসীদের সমালোচনা “দেশের বাস্তবতা না জানা ধনী প্রবাসীদের মন্তব্য” বলে খারিজ করা হয়।
• এই পর্বটি দেখায়, জাতপাতের প্রশ্ন কীভাবে প্রবাসে কূটনীতি, গণমত ও নীতিনির্ধারণে আলোচনার অংশ হয়ে ওঠে।

প্রবাসে দলিত সংগঠন ও আন্দোলন
- লেখক তুলে ধরেছেন যে আটলান্টিক ছিল দাসত্বের পথ,আর ভারত মহাসাগর ছিল ইন্ডেনচার্ড শ্রমের পথ—দুই সাগর দুই ভিন্ন অভিবাসী বাস্তবতা তৈরি করেছে।
• ত্রিনিদাদে মধ্য ও নিম্নজাতের বহু মানুষ চুক্তিভিত্তিক শ্রমে আগত; ধর্মীয় আখ্যান (রামায়ণ ইত্যাদি), সামাজিক মিলনসভা ও ব্যক্তিগত পরিচয়ে জাতপাত সেখানে নানা রূপে প্রকাশ পায়।
• যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত জাতের অভিবাসন বেশি; সেখানে পেশাগত নেটওয়ার্ক, মন্দির, সমিতি ও কমিউনিটি জীবনে “অদৃশ্য” জাত-স্তরবিন্যাস সক্রিয়, যা দলিত গোষ্ঠীর দৃশ্যমানতার পথে বড় বাধা।
• দুটি অধ্যায়ে প্রবাসী দলিতদের সংগঠন, নীতিতে প্রভাব বিস্তার ও আত্মপ্রকাশের ধাপভিত্তিক বিশ্লেষণ রয়েছে।
কৃষ্ণাঙ্গ–দলিত তুলনা: সাযুজ্য ও পার্থক্য
- জাতপাত ও বর্ণবাদের তুলনা দীর্ঘদিনের বিতর্কের বিষয়। লেখক আবেগ নয়,তথ্য-নির্ভর বিশ্লেষণে মিল-অমিল স্পষ্ট করেন।
• কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্য-দর্শন ও দলিত সাহিত্য-আন্দোলনের সংলাপ কোথায় ফলপ্রসূ, কোথায় সীমাবদ্ধ—এই নিরীক্ষাই বইটির অন্যতম শক্তি।
• সরল তুলনা এড়িয়ে লেখক সম্পর্কের জটিলতা ও সামাজিক বাস্তবতার সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।
আর্কাইভ থেকে মানুষ ও পত্রিকার ভান্ডার
- এম. এন. ওয়াঁখেড়ে: ঐতিহাসিক মিলিন্দ কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক;কৃষ্ণাঙ্গ–দলিত সাহিত্যের সেতুবন্ধন ও প্রভাবশালী মারাঠি পত্রিকা ‘অসমিতা’র প্রতিষ্ঠাতা।
• পণ্ডিত তিরুভেঙ্কটাসামি: নিজেকে ‘আদিদ্রাবিড়’ হিসেবে চিহ্নিত; ১৮৭২ সালে ‘সূর্যোদয়ম’ নামে প্রথম দলিত সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।
• শিবরাম জানবা কাম্বলে: ১৯০৮ সালে মারাঠি পত্রিকা ‘সোমবংশীয় মিত্র’ শুরু করে জাতপাত-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।
• এই সব নাম ও ঘটনার নিখুঁত খতিয়ান বইটিকে প্রামাণ্যতা দেয়, যদিও অতিরিক্ত তালিকাবদ্ধ তথ্য মাঝে মাঝে বর্ণনার গতি মন্থর করে।
উপনিবেশিক শ্রেণিবিন্যাস ও রাষ্ট্রনীতি
- উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ শাসকদের জনগণনায় জাতশ্রেণি“নকশা” করার কৌশল ও এর প্রভাব নিয়ে গভীর সমালোচনা রয়েছে।
• সাংবিধানিক চিন্তাবিদ বি. এন. রাউয়ের লেখনী ও ব্যক্ত মতামতে জাত্যাভিমানের বিস্ময়কর উপস্থিতি লেখক বিশ্লেষণ করেছেন।
• নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতির আলোচনায় মহারাষ্ট্র-কেন্দ্রিক উদাহরণ বেশি, যা বইয়ের বিস্তারের ক্ষেত্রে সামান্য ঘাটতি বলে মনে হতে পারে।

লেখনশৈলী: শক্তি ও সীমা
- ছয় অধ্যায়ের এই সংকুচিত অথচ বিস্তৃত বইটি আর্কাইভ,নৃবিজ্ঞান ও মাঠ-গবেষণায় ভর করে লেখা—কখনো ঘন, কখনো খণ্ডিত।
• নবাগত পাঠকের জন্য নাম-তালিকা ও তথ্যের ঘনত্ব চ্যালেঞ্জ হতে পারে; তবে প্রতিটি বিন্দু থেকে যে অন্তর্দৃষ্টি উঠে আসে, তা গবেষণার পরিশ্রমকে সার্থক করে।
• বইটি লেখকের আগের কাজ ‘কাস্ট ম্যাটার্স’-এর তুলনায় বেশি তথ্যনির্ভর, কম প্ররোচনামূলক; তথ্যে ভরপুর এই গবেষণা পাঠককে গভীর উপলব্ধির পথে নিয়ে যায়।
দলিত ফিউচারিজম ও সার্বজনীনতার অনুসন্ধান
- বইটি কেবল অতীত নয়;ভবিষ্যত পরিকল্পনায় দলিত কল্পনা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও ন্যায়ের কাঠামো নিয়ে ভাবনার দুয়ার খোলে—‘দলিত ফিউচারিজম’ এখানে আশাবাদের নতুন প্রতীক।
• বৈশ্বিক ন্যায়, মানবমর্যাদা ও সমঅধিকারের দর্শনে দলিত জীবনকে কেন্দ্রে রেখে সার্বজনীনতার নতুন ধারণা নির্মাণই বইটির সবচেয়ে মূল্যবান দিক।
কেন আজও প্রাসঙ্গিক
- প্রবাসে জাতপাতের প্রকাশ-অপ্রকাশ,নীতিনির্মাণে অদৃশ্য বৈষম্যকে দৃশ্যমান করার সংগ্রাম, এবং ইতিহাসের পাদটীকায় থাকা মানুষদের মূলধারায় আনার প্রয়াস—সবকিছু আজকের বিশ্বায়িত সমাজে আরও জরুরি।
• গণতন্ত্র, অধিকার ও বহুত্ববাদে দলিত অবদানের অবমূল্যায়ন ও মুছে ফেলার বিরুদ্ধে বইটি এক শক্তিশালী প্রতিপাদ্য দলিল।
‘কাস্ট: আ গ্লোবাল স্টোরি’ তথ্য ও বিশ্লেষণে ঘন হলেও প্রবাসী সমাজ, উপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও সমসাময়িক ন্যায়-রাজনীতিতে জাতপাত বোঝার জন্য এটি অপরিহার্য পাঠ। ইতিহাসের আড়ালে থাকা মানুষ, সংগঠন ও অভিজ্ঞতার আলোয় বইটি এক অনন্য সংকলন—দলিত জীবনদর্শনকে সার্বজনীনতার ভাষায় নতুন করে উচ্চারণ করেছে।
কাস্ট: আ গ্লোবাল স্টোরি
সুরাজ মিলিন্দ ইয়েংদে
পৃষ্ঠা: ৩৮৪
প্রকাশক: পেঙ্গুইন
মূল্য: ₹৮৯৯ (প্রকাশকের তালিকামূল্য অনুসারে)
#জাতপাত #দলিত_আন্দোলন #প্রবাসী_সমাজ #বই_পর্যালোচনা #Caste #SurajYengde #DalitStudies #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















