সিঙ্গাপুরের ঐতিহাসিক স্থাপনা ‘দ্য হাউস অব তান ইয়োক নি’ ১৪০ বছর পর প্রথমবারের মতো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হলো। পুনর্নির্মিত এই তিওচিউ প্রাসাদ এখন শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয়, বরং শিল্প, সংস্কৃতি ও রন্ধনশৈলীর সমন্বয়ে এক আধুনিক জীবনধারার কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ঐতিহাসিক স্থাপনার পুনর্জন্ম
১৮৮২ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে নির্মিত এই দুইতলা প্রাসাদটি ছিল চীনের গুয়াংডং প্রদেশের চাওঝো অঞ্চলের বণিক তান ইয়োক নি’র ব্যক্তিগত বাসভবন। সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে এটি তিওচিউ ধনীদের নির্মিত চারটি ‘গ্র্যান্ড ম্যানশন’-এর মধ্যে একমাত্র অবশিষ্ট স্থাপনা। ১৯৭৪ সালে এটি জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
২০২২ সালে করিম ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন এই প্রাসাদটি কিনে নেয় এবং ২০২৪ সালে ডিপি আর্কিটেক্টস (ডিপিএ) ও সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের অধ্যাপক ইয়ো কাং শুয়া’র তত্ত্বাবধানে এর ব্যাপক পুনর্নির্মাণ শুরু হয়।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
২৬,৩২১ বর্গফুট ফ্রি-হোল্ড জমির ওপর অবস্থিত এই প্রাসাদে রয়েছে দুটি আঙিনা, একটি মূল বাসভবন, আর আশপাশের স্থানগুলো করিম গ্রুপের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নবায়নের পর এখানে তৈরি হয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী গ্যালারি, আধুনিক জাপানি–ফরাসি ফিউশন রেস্তোরাঁ ‘লোকা নিরু’, এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য ইভেন্ট স্পেস।
শিল্প ও ঐতিহ্যের প্রদর্শনী
নতুন স্থাপনায় দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারবেন স্থাপত্য ও কারুকাজের নিদর্শন। এখানকার প্রথম ‘আর্টিস্ট-ইন-রেসিডেন্স’ হিসেবে কাজ করছেন তান ইয়োক নি’র প্রপৌত্র, সিঙ্গাপুরীয় শিল্পী তান নিয়াপ হেং (৫৯)। তিনি গ্যালারিতে ‘বংশপরম্পরা ও পরিচয়’ নিয়ে দুটি সিরিজ প্রদর্শন করছেন।
তিনি বলেন, “এই পুনর্নির্মাণের ফলে আমাদের পরিবার এখন যে কোনো সময় এই প্রাসাদে আসতে পারে, জনসাধারণের মতোই। আগে এর জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হতো।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য
৩০ অক্টোবরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডউইন টং বলেন, “ঐতিহ্য কেবল দেখার বস্তু নয়, এটি এমন এক জীবন্ত স্থান হওয়া উচিত, যেখানে সংস্কৃতি বিকশিত হয় এবং নতুন প্রজন্ম তা অনুভব করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “শিল্প ও ঐতিহ্যে সহায়তা শুধু অর্থের বিষয় নয়, এটি কল্পনাশক্তিরও প্রকাশ। অতীতকে নতুন জীবন দেওয়া মানেই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা, প্রজন্মের পর প্রজন্মে তা ছড়িয়ে দেওয়া।”
কমিউনিটির জন্য নতুন দ্বার
করিম ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের প্রধান সিন্ডি করিম জানান, “এই বাড়ির দরজা এখন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এটি আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি ও কমিউনিটির অংশ।”
ইন্দোনেশীয়–চীনা বংশোদ্ভূত করিম পরিবার সিঙ্গাপুরে তাদের দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে অবদান রাখছেন। তিনি বলেন, “দাতব্য কাজ শুধু দান নয়, এটি এমন এক প্রচেষ্টা যা সমাজের পরিচয় ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখে।”
কারুশিল্প ও স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন
তিওচিউ স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এই ভবনের ছাদ ও দেয়ালে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সিরামিক টুকরো দিয়ে তৈরি অলংকরণ, যেখানে দেখা যায় পৌরাণিক চরিত্র ‘তিন দেবতা’ (সম্পদ, সৌভাগ্য ও দীর্ঘায়ু) ও ‘আট অমর’—এর প্রতিকৃতি।
কাঠের খোদাইয়ে দেখা যায় ফিনিক্স ও পিওনি ফুলের নকশা, যা সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের প্রতীক। প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে ড্রাগনফিশ-আকৃতির কার্নিশ ও কার্প-আকৃতির বৃষ্টিনিষ্কাশন পাইপ।
অতীত থেকে বর্তমান
১৪০ বছরের ইতিহাসে এই প্রাসাদ বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার হয়েছে পারিবারিক বাসভবন, অনাথ আশ্রম, স্যালভেশন আর্মির কার্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসালয় হিসেবে।
করিম পরিবার প্রাসাদটি ২০২২ সালে ৮৫ থেকে ৯২ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে একটি অপ্রকাশিত মূল্যে কিনেছিল বলে ধারণা করা হয়। পুনর্নির্মাণসহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
জনসাধারণের অংশগ্রহণ
১ ও ২ নভেম্বর সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে থাকবে গাইডেড ট্যুর, ক্ষুদ্র-তিওচিউ খাবার উৎসব, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
সিন্ডি করিম বলেন, “প্রতিটি সিরামিক টুকরো, প্রতিটি খোদাই ও প্রতিটি দেয়ালচিত্র আমাদের প্রবাসী তিওচিউ পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য, দক্ষতা ও উদ্যোক্তা মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।”
# সিঙ্গাপুর, #ঐতিহ্য, #পুনর্নির্মাণ,# তিওচিউ, #স্থাপত্য, #করিম ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন, #সংস্কৃতি, #ইতিহাস, #সারাক্ষণ রিপোর্ট
																			
																সারাক্ষণ রিপোর্ট 								 





















