‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ নাকি গোপন যুদ্ধের স্থপতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে তুলে ধরেছেন “শান্তির প্রেসিডেন্ট” হিসেবে—একজন নেতা যিনি অন্তহীন যুদ্ধের অবসান ঘটান, সৈন্যদের ঘরে ফেরান এবং বিদেশি জটিলতা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এই ধারণাটি যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবতা ততটাই বিভ্রান্তিকর।
ট্রাম্পের কাছে যুদ্ধের সংজ্ঞা সীমিত—যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপক সৈন্য মোতায়েন বা দীর্ঘস্থায়ী দখল না ঘটে, ততক্ষণ তা যুদ্ধ নয়। ড্রোন হামলা বা ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে নিহতদের তিনি “অদৃশ্য পরিসংখ্যান” বলে উপেক্ষা করেন।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শান্তি মানে কেবল যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, বরং সংযম। আর সেই সংযমে ট্রাম্প সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
আন্তর্জাতিক জলসীমায় মার্কিন হামলা: মৃত্যুর মিছিল
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরে একাধিক সামরিক হামলা চালিয়েছে। হোয়াইট হাউস দাবি করছে, এগুলো ছিল “চোরাচালানবিরোধী অভিযান”। কিন্তু বাস্তবে এগুলো ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞ, যেখানে ডজনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
এই অভিযানগুলো কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই আন্তর্জাতিক জলসীমায় পরিচালিত হচ্ছে—যা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণারই সমতুল্য।
মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী পিট হেগসেথ এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, “এই হামলাগুলো প্রতিদিন চলবে। এরা কেবল মাদক পাচারকারী নয়, এরা নেশা-সন্ত্রাসী।”
একই সঙ্গে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে “অপরাধচক্রের নেতা” আখ্যা দিয়েছেন, যদিও কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ভেনেজুয়েলার উপকূলে অবস্থান করছে—যা এক নতুন সংঘাতের ছায়া তৈরি করছে।

‘নেশা দমন’ না ‘গোপন যুদ্ধ’?
গত সপ্তাহে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ঘোষণা করেছে, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে চারটি নৌকায় হামলায় ১৪ জন নিহত ও একজন জীবিত উদ্ধার হয়েছে। এটি ছিল ট্রাম্পের সমুদ্র অভিযানের সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন।
প্রশাসনের দাবি—এই অভিযান ছিল “নেশা দমন” বা “সন্ত্রাসবিরোধী” পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—মানবিকতা বা আইনের শাসনের সঙ্গে নৌকা উড়িয়ে দেওয়ার সম্পর্ক কোথায়?
“কাউন্টার-নেশা” বা “কাউন্টার-সন্ত্রাস”—এই শব্দগুলো আজকের যুগে নৈতিকতার মুখোশ। যখন আপনি আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো লক্ষ্যবস্তুতে বিস্ফোরণ ঘটান, তখন আপনি কি যোদ্ধা, না কি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী?
শক্তির প্রদর্শনই নীতি
যখন কোনো নৌকা বিস্ফোরণের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়ায় এবং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিজে তা গর্বভরে শেয়ার করেন, তখন বার্তাটি স্পষ্ট:
“যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ নাও করতে পারে, কিন্তু ধ্বংস করতে জানে।”
এই প্রবণতা কেবল বাইরের ক্ষেত্রে নয়, দেশের ভেতরেও দৃশ্যমান। লস অ্যাঞ্জেলেস ও শিকাগোর রাস্তায় সাঁজোয়া যান আর সৈন্য মোতায়েনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প দেশেও একই শক্তির রাজনীতি চালু করেছেন। তার কাছে “আইন প্রয়োগ” মানে হলো ক্ষমতার প্রদর্শন।
তার দর্শন একটাই—“শৃঙ্খলা আসে ভয়ে, শান্তি আসে শক্তি দিয়ে।”
আইন, ন্যায়বিচার ও প্রতিশোধের সীমারেখা মুছে ফেলা
যখন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাদক পাচারকারীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে, তখন তা আইন ও ন্যায়বিচারের মূলনীতিকেই ভেঙে দেয়।
অপরাধ আর যুদ্ধের সীমারেখা মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর এতে রাষ্ট্রের প্রতিশোধই ন্যায়বিচারের স্থান নিচ্ছে।
এই নীতি শুধু নৈতিক সংকটই তৈরি করছে না, বরং বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বার্তাও স্পষ্ট করছে—এখন আমেরিকার ন্যায়বিচার আদালতে নয়, মিসাইলের নলে।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতা: ট্রাম্প কেবল মুখোশ সরালেন
ট্রাম্প এই ধারা তৈরি করেননি; তিনি কেবল তা প্রকাশ্যে এনেছেন।
হ্যারি ট্রুম্যান কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই কোরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, লিন্ডন জনসন ভুয়া টঙ্কিন উপসাগর ঘটনার ভিত্তিতে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, আর বিল ক্লিনটন কসোভোতে বোমা ফেলেছিলেন।
১৯৭৩ সালের “ওয়ার পাওয়ারস অ্যাক্ট” প্রেসিডেন্টের যুদ্ধক্ষমতা সীমিত করার উদ্দেশ্যে পাস হলেও, এখন তা কেবল প্রতীকী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাম্প সেই ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী, তবে তিনি সেটিকে পূর্ণমাত্রায় প্রদর্শনমূলক রূপে রূপান্তরিত করেছেন।
শান্তির মুখোশে প্রতিশোধের রাজনীতি
ট্রাম্পের পূর্বসূরিরা যুদ্ধকে নৈতিকতার ছদ্মবেশে উপস্থাপন করতেন, কিন্তু ট্রাম্প একে প্রকাশ্যে প্রতিশোধের থিয়েটারে রূপ দিয়েছেন।
তার কাছে “শান্তি” মানে সংযম নয়, বরং বৈধতার ছদ্মবেশে শিকার। তিনি মধ্যস্থতা করেন না; তার “শান্তি” আসে ক্লান্তি বা কৌশলগত পিছু হটার মাধ্যমে, কোনো কূটনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নয়।
সংজ্ঞার খেলায় যুদ্ধ ও শান্তি
ট্রাম্প যুদ্ধের সংজ্ঞাকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছেন, যেখানে যতক্ষণ পূর্ণমাত্রার আক্রমণ না হয়, ততক্ষণ তা যুদ্ধ নয়।
নৌকা ধ্বংস, ড্রোন হামলা, সৈন্য মোতায়েন—সবই তার চোখে “শান্তি রক্ষা”।
অন্য নেতারা “শান্তির আড়ালে যুদ্ধ” লুকাতেন; ট্রাম্প তা প্রকাশ্যে পরিণত করেছেন।

শেষ বিশ্লেষণ: অসীম যুদ্ধ নয়, অসীম দায়মুক্তি
ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি কেবল যুদ্ধক্ষেত্র পরিবর্তন করেছেন—এখন যুদ্ধ হচ্ছে পর্দায়, সমুদ্রের ঢেউয়ে, কিংবা সামাজিক মাধ্যমের ভিডিও ক্লিপে।
এটাই ট্রাম্পের উত্তরাধিকার: অন্তহীন যুদ্ধ নয়, বরং অন্তহীন দায়মুক্তি।
যদি যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তি কিভাবে ও কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে আর পরোয়া না করে, তবে “শান্তির প্রেসিডেন্ট” ট্রাম্পের মিথ শুধু ভ্রান্ত নয়—এটি এক গুরুতর সতর্কবার্তা:
যে যুগে শান্তির অর্থই বিলীন হয়ে যেতে পারে।
																			
																থমাস ও. ফক								 



















