প্রস্তাবনা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তিকে নিজের রাজনৈতিক প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন। এআই-নির্ভর ভুয়া ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে, তিনি শুধু নিজের সমর্থকদের আকৃষ্ট করছেন না, বরং বিরোধীদের আক্রমণ ও নীতিগত বার্তা ছড়ানোর নতুন কৌশলও তৈরি করেছেন।
এআই-চিত্রে রাজনৈতিক বার্তা ও আত্মপ্রচার
২০২২ সালের শেষ দিক থেকে ট্রাম্প তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ অ্যাকাউন্টে অন্তত ৬২টি এআই-নির্ভর ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে কিছু ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদের আক্রমণ করার জন্য, আবার কিছুতে তাঁকে রাজা ও যোদ্ধার রূপে দেখা গেছে। অনেক পোস্টে ট্রাম্প নিজেকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব ছবি ও ভিডিওর কিছু অংশে সরাসরি বিভ্রান্তি ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। এমনকি যেসব পোস্টে হাস্যরস বা অতিরঞ্জনের ছাপ রয়েছে, সেগুলোও আধুনিক রাজনৈতিক প্রচারণার নতুন রূপকে স্বাভাবিক করে তুলছে।

বিরোধীদের টার্গেট ও নীতিগত প্রচারণা
ট্রাম্প অন্তত ১৪ বার এআই ব্যবহার করে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের আক্রমণ করেছেন। একাধিক ভিডিওতে তাঁকে নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবে রূপ দিতে দেখা গেছে—যেমন কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখানো কিংবা নিজেকে ‘কেনেডি সেন্টারের কন্ডাক্টর’ রূপে উপস্থাপন করা।
একটি বিতর্কিত ভিডিওতে ট্রাম্পকে দেখা যায় ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফ্রিজকে মেক্সিকান পোশাকে চিত্রিত করতে যেখানে চাক শুমার কণ্ঠস্বরকেও এআই-এর মাধ্যমে বিকৃত করা হয়েছে। সমালোচনার মুখে ট্রাম্প এরপর একই ভিডিওর রসিক সংস্করণ প্রকাশ করেন, যেখানে চারটি এআই ভিডিওতে ট্রাম্পকে দেখা যায় মারিয়াচি ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে।
জাতীয় বিতর্কে এআই-এর ব্যবহার
প্রতিক্রিয়াশীল ইস্যুতে ট্রাম্পের এআই ব্যবহার প্রায়ই তীব্র সমালোচনা উসকে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে তিনি ‘ট্রাম্প গাজা’ নামের একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলকে এক স্বপ্নীল সমুদ্রতট ও নিজের স্বর্ণমূর্তির সহিত পুনরায় কল্পনা করা হয়েছে।
ডেমোক্র্যাটরা একে ‘অসঙ্গত ও অপমানজনক’ বলে নিন্দা জানালেও হোয়াইট হাউস একে “দূরদর্শী পদক্ষেপ” হিসেবে আখ্যা দেয়।

এছাড়া ‘ক্র্যাকার ব্যারেল’ রেস্টুরেন্টের লোগো পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কের পর ট্রাম্প একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে তাঁকে দেখা যায় ঐ লোগোর সাদা মানুষের সঙ্গে হাত মেলাতে। আবার শিকাগোতে জাতীয় রক্ষী পাঠানোর সিদ্ধান্তের আগ মুহূর্তে তিনি ‘Apocalypse Now’–এর অনুকরণে ‘Chipocalypse Now’ নামে একটি এআই ভিডিও শেয়ার করেন, যার ক্যাপশনে লেখা ছিল: “শিকাগো এখন বুঝবে কেন এটি যুদ্ধ বিভাগ নামে পরিচিত।”
বিভ্রান্তি ও বাস্তবতার সীমা
ট্রাম্পের কিছু এআই ভিডিও এতটাই বাস্তবসম্মত যে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার “গ্রেফতার” সংবলিত একটি এআই ভিডিও অনেকেই সত্য বলে বিশ্বাস করেছিলেন।
এক ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, “এটা কি সত্যিই ঘটেছে?” যা প্রমাণ করে যে এআই-প্রচার এখন বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এআই-প্রচার দলের উত্থান
‘ডিলি ৩০০০ মিম টিম’ নামের একটি দল ট্রাম্পের জন্য ডজনখানেক ভিডিও তৈরি করেছে, যেখানে ডেমোক্র্যাটদের কটাক্ষ এবং ট্রাম্পের প্রশংসা একসঙ্গে ফুটে ওঠে। দলের নেতা ব্রেন্ডেন ডিলি একবার লিখেছিলেন, “এখন আর সত্যের প্রয়োজন নেই—ভাইরাল হওয়াটাই আসল লক্ষ্য।”

এই প্রচারণা দল ও ট্রাম্পের সহযোগিতায় তৈরি ভিডিওগুলো এখন এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলছে, যেখানে তথ্যের বদলে বিনোদনই প্রভাব বিস্তার করছে।
প্রযুক্তির অগ্রগতি ও বিশ্বব্যাপী প্রবণতা
এআই প্রযুক্তি ২০২২ সালের তুলনায় এখন অনেক বেশি উন্নত। আগের মতো স্পষ্ট ভুয়া নয়, বরং এখন এগুলো প্রায় বাস্তবসম্মত চিত্র তৈরি করতে সক্ষম। সারা বিশ্বেই রাজনীতিবিদরা এখন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের বার্তা প্রচারে ব্যস্ত। কেউ কেউ অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য জোরালো করতে ওভারভরা শ্রেণিকক্ষ বা অব্যবস্থাপনা চিত্রিত এআই ছবি ব্যবহার করছেন।
ট্রাম্প তাঁর প্রচারণায় “ওপেন বর্ডার” নীতির পরিণতি বোঝাতে দুটি এআই চিত্র তুলনা করেন—একটিতে শান্তিপূর্ণ আমেরিকা, অন্যটিতে আবর্জনায় ভরা বিশৃঙ্খল দৃশ্য।
ট্রাম্পের এআই ব্যবহারের পেছনে রয়েছে একদিকে আত্মপ্রচার, অন্যদিকে বিভাজনমূলক রাজনীতি। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই এআই-নির্ভর ভুয়া প্রচারণা রাজনৈতিক যোগাযোগের নতুন মানদণ্ডে পরিণত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, “যখন তথ্যের চেয়ে প্রচারণা বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, তখন সত্যের চেয়ে ভাইরাল হওয়াই, রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।”
																			
																সারাক্ষণ রিপোর্ট								 



















