ম্যাগা ধারার বৌদ্ধিক উৎস অনুসন্ধান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনীতিতে “মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন” বা ম্যাগা আন্দোলন শুধু এক রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং এক গভীর আদর্শিক প্রবাহের প্রতিফলন। লরা কে. ফিল্ড তার বই ‘Furious Minds: The Making of the MAGA New Right’-এ এই আন্দোলনের বৌদ্ধিক উৎস অনুসন্ধান করেছেন।
তিনি ট্রাম্প-যুগের রক্ষণশীল আন্দোলনের ভেতরের তিনটি মূল ধারাকে বিশ্লেষণ করেন—ক্লেয়ারমন্টার্স, পোস্টলিবারেলস, এবং ন্যাশনাল কনজারভেটিভস (ন্যাটকনস)।
ক্লেয়ারমন্টার্স: ট্রাম্পপন্থী চিন্তার জন্মভূমি
ক্লেয়ারমন্টার্সরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেয়ারমন্ট ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত একদল চিন্তাবিদ ও কর্মী, যাদের ভিত্তি দার্শনিক হ্যারি জাফার চিন্তাধারায়। জাফা ছিলেন লিও স্ট্রসের ছাত্র এবং আমেরিকার প্রতিষ্ঠা নীতিকে কেন্দ্র করে নতুন রক্ষণশীল চিন্তাধারার নির্মাতা।
ফিল্ড মনে করিয়ে দেন ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত মাইকেল অ্যান্টনের বিখ্যাত প্রবন্ধ “The Flight 93 Election”-এর কথা, যা ট্রাম্প সমর্থনে ক্লেয়ারমন্ট ইনস্টিটিউটের অবস্থানকে প্রকাশ করে।
অ্যান্টন এই প্রবন্ধে বলেন, মার্কিন ভোটারদের উচিত “হাইজ্যাক হওয়া বিমানের যাত্রীদের মতো সাহসী হয়ে” দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, নইলে তারা ধ্বংসের মুখে পড়বে। তার দৃষ্টিতে হিলারি ক্লিনটনের বিজয় ছিল আমেরিকার অস্তিত্বের জন্য হুমকি।
ফিল্ড এই প্রবন্ধে “অ্যাপোক্যালিপ্টিক চিন্তাধারা” ও ষড়যন্ত্রমূলক মনোভাব খুঁজে পান। এতে দেখা যায়এক “শেষ নির্বাচন” ধারণা,
- প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে “বিশ্বাসঘাতকতা”র অভিযোগ,
- আমেরিকানদের বন্ধুবান্ধব ও শত্রুতে ভাগ করা,
- এবং ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীল আন্দোলনের ব্যর্থতার দাবি।
পোস্টলিবারেলস: উদারনীতির ব্যর্থতার ঘোষণা
ফিল্ড এরপর মনোযোগ দেন প্যাট্রিক ডিনিন-এর দিকে, যিনি নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ‘Why Liberalism Failed’ (২০১৮) ও ‘Regime Change’ (২০২৩) বইয়ের লেখক।
ডিনিন যুক্তি দেন, পশ্চিমা উদারনীতি (লিবারেলিজম) নিজেই নিজের সাফল্যের কারণে ব্যর্থ হয়েছে। তার মতে, এই আদর্শ ধর্ম, পরিবার ও সমাজের মূল্যবোধকে প্রতিস্থাপন করেছে স্বার্থপরতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নিওলিবারেল অর্থনীতির মাধ্যমে।
পোস্টলিবারেল চিন্তাবিদরা যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যার জন্য প্রগতিশীলতাকে নয়, বরং মার্কিন সংবিধানকেই দায়ী করেন।
ডিনিন মনে করেন, থমাস হবস ও জন লকের ভাবনা থেকে জন্ম নেওয়া আমেরিকান প্রতিষ্ঠা-দর্শন অর্থনীতিকে এক “অবিবেচক স্বাধীনতা” দিয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তার ‘Regime Change’-এ তিনি এক নতুন নৈতিক অভিজাত শ্রেণির আহ্বান জানান, যারা খ্রিষ্টান মূল্যবোধ ও সমাজকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক নীতি মিলিয়ে দেশ পুনর্গঠন করবে। ফিল্ড উল্লেখ করেন, ডিনিনের এই চিন্তা মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে প্রভাবিত করেছে।
ন্যাশনাল কনজারভেটিভস (ন্যাটকনস): জাতীয়তাবাদী নতুন তরঙ্গ
ন্যাটকন আন্দোলনের সূচনা ২০১৯ সালে। এর নেতৃত্বে আছেন ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত লেখক ইওরাম হাজনি।
তিনি “ন্যাটকন কনফারেন্স”-এর মাধ্যমে এক আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদী জোট গড়ে তোলেন, যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনীতিবিদেরা অংশ নেন।
ফিল্ডের মতে, ন্যাটকনরা এমন এক গোঁড়া জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকছে, যা “ব্যক্তিস্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ (বা কখনও সংখ্যালঘু) শক্তির প্রকাশ” ঘটায়।
২০২২ সালের মিয়ামি সম্মেলনে হাজনি বলেন,
“ওয়োক নব্য-মার্কসবাদী ধর্মকে রুখতে একমাত্র শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হলো বাইবেলভিত্তিক খ্রিষ্টান ধর্ম।”
ফিল্ড মনে করেন, এখানেই ন্যাটকনদের মুখোশ খুলে যায় এবং তাদের ভাবনায় “শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য” ও “খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদ”-এর ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, ন্যাটকনরা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও স্বাধীনতার মূলনীতির সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তাদের জাতীয়তাবাদ আমেরিকার ঐতিহাসিক দলিল—স্বাধীনতার ঘোষণা, সংবিধান ও ফেডারেলিস্ট পেপারস—থেকে বিচ্ছিন্ন।
বৌদ্ধিক প্রভাব ও সমালোচনা: স্ট্রস থেকে জাফা
ফিল্ড আরও দেখিয়েছেন, নিউ রাইটের ভাবনার মূলে রয়েছেন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ—লিও স্ট্রস, অ্যালান ব্লুম, হ্যারি জাফা, চার্লস কেসলার ও হার্ভে ম্যানসফিল্ড।
তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আমেরিকান রক্ষণশীলতাকে প্রভাবিত করেছেন।
তিনি সমালোচনা করেন হ্যারি জাফার ধারণাকে, যিনি মনে করতেন আমেরিকার প্রতিষ্ঠা নীতিই দাসত্ব ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তমূলক অস্ত্র।
ফিল্ড মনে করেন, এটি ইতিহাসের বাস্তবতা উপেক্ষা করে একধরনের কাল্পনিক বিশ্লেষণ।
তবে লেখক রিচার্ড এম. রেইনশ II এই সমালোচনাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন না। তার মতে, জাফার দৃঢ় অবস্থান তার ব্যক্তিত্বের ফল, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির নয়।
নিউ রাইটের রোষের প্রকৃত উৎস
ফিল্ডের কাজ বৌদ্ধিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ হলেও রেইনশ মনে করেন, তিনি লিবারেল আদর্শের অন্তর্নিহিত সংকট—যেখানে জাতি ও লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন বাড়ছে—তা বিশ্লেষণ করেননি।
তার মতে, আধুনিক লিবারেলিজমের এই “জাতিগত ও যৌন উপজাতি”-কেন্দ্রিক রাজনীতি বরং নিউ রাইটের “রাগী মন”-এর জন্ম দিয়েছে, দার্শনিক তত্ত্ব নয়।
লরা কে. ফিল্ডের ‘Furious Minds’ বইটি ট্রাম্প-যুগের নতুন রক্ষণশীল আন্দোলনের বৌদ্ধিক মানচিত্র আঁকে।
ক্লেয়ারমন্ট ইনস্টিটিউটের তীব্র ট্রাম্পপন্থা, ডিনিনের সংবিধান-বিরোধী পোস্টলিবারেল তত্ত্ব, এবং হাজনির খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদ—এই তিন প্রবাহ মিলে গড়ে তুলেছে “নিউ রাইট”-এর আধুনিক মুখ।
তবে রেইনশের দৃষ্টিতে, এই আন্দোলনের প্রকৃত জ্বালানি দার্শনিক বিতর্ক নয়, বরং আধুনিক লিবারেল সমাজের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও মূল্যবোধের সঙ্কট।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















