দক্ষিণ অন্টারিওর জীববৈচিত্র্যের সংকট
দক্ষিণ অন্টারিওর গ্রামীণ অঞ্চল একদিকে যেমন মনোরম কৃষিজমি, শহরতলির সম্প্রসারণ এবং চিত্তাকর্ষক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, অন্যদিকে এটি এখন অন্তত ১৩৩ প্রজাতির পাখি, প্রাণী, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে উঠেছে। এদের অনেকেই প্রদেশ থেকে বিলুপ্তির পথে, কেউ কেউ সম্পূর্ণ ধ্বংসের আশঙ্কায় রয়েছে।
এই পরিস্থিতি বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সামনে বড় প্রশ্ন তুলেছে—এত বিপন্ন প্রজাতিকে কীভাবে কার্যকরভাবে রক্ষা করা সম্ভব এমন এক অঞ্চলে, যেখানে জনসংখ্যা ঘন এবং জমির ব্যবহার অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়?
গবেষণার লক্ষ্য ও মূল ফলাফল
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজারভেশন ডিসিশনস ল্যাব–এর প্রধান ড. তারা মার্টিন ও তাঁর দল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কাজ করেছেন। তাদের সাম্প্রতিক গবেষণা, যা সোমবার প্রকাশিত হয়েছে ‘ইকোলজিক্যাল সলিউশনস অ্যান্ড এভিডেন্স’ জার্নালে, দক্ষিণ অন্টারিওর বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষায় সম্ভাব্য খরচ ও কৌশল তুলে ধরেছে।
গবেষণাটি বলছে—যদি প্রতি বছর গড়ে ১১.৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে ২৭ বছরে অঞ্চলের অধিকাংশ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

এই ব্যয়-পরিকল্পনা শুধু অর্থের পরিমাণই নয়, বরং কীভাবে সংরক্ষণ তহবিল সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা নিয়েও একটি কৌশলগত রূপরেখা প্রদান করে।
জটিল ভূমি-ব্যবহার ও আইনি সীমাবদ্ধতা
দক্ষিণ অন্টারিওর বড় অংশই ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি, যেখানে ফেডারেল ‘Species at Risk Act’ কার্যকর নয়। যদিও প্রদেশটির নিজস্ব প্রজাতি সুরক্ষা আইন রয়েছে, ২০২৫ সালে ফোর্ড সরকার ‘বিল ৫’ পাস করার পর এই আইনের অনেক দিক পরিবর্তিত হয়েছে।
নতুন আইন প্রাকৃতিক স্থানগুলিতে উন্নয়ন কার্যক্রম সহজ করেছে এবং বহু প্রজাতির সুরক্ষা কমিয়ে দিয়েছে।
ড. মার্টিন বলেন, “ওই অঞ্চলের প্রজাতিগুলোর এখন কার্যত কোনো শক্তিশালী ফেডারেল বা প্রাদেশিক সুরক্ষা নেই।”
গবেষণার পরিধি ও পদ্ধতি
গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে WWF কানাডার সহযোগিতায়। ড. মার্টিনের দল ‘প্রায়োরিটি থ্রেট ম্যানেজমেন্ট’ নামক একটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, যেখানে সীমিত সম্পদকে সবচেয়ে ফলপ্রসূভাবে ব্যবহারের কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
এই গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৬৩ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত লেক সিমকো–রিডো ইকোরিজন। এলাকাটিতে বন, কৃষিজমি, জলাভূমি ও শহরাঞ্চল মিলেমিশে রয়েছে। এটি পূর্বে অটোয়া নদী উপত্যকা থেকে পশ্চিমে লেক সিমকো, ব্রুস উপদ্বীপ এবং ম্যানিটুলিন দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত।
গবেষণায় গ্রেটার টরন্টো এলাকা বা দক্ষিণ–পশ্চিম অন্টারিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, কারণ সেগুলোর নিজস্ব পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য আলাদা।

বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও পরিকল্পিত কার্যক্রম
২০২২ সালে গবেষকরা ১৩৩টি প্রজাতিকে ১৬টি পরিবেশগত গোষ্ঠীতে ভাগ করেন এবং প্রত্যেকটির জন্য প্রধান হুমকি ও তার মোকাবিলায় করণীয় পদক্ষেপ নির্ধারণ করেন।
লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০৫০ সাল পর্যন্ত—যা কুনমিং–মন্ট্রিয়াল গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক–এর সময়সীমার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসন, আদিবাসী সম্প্রদায়, পরিবেশবিদ, শিল্পপতি এবং গবেষকরা অংশ নেন। প্রস্তাবিত পদক্ষেপের মধ্যে ছিল নতুন আইন প্রণয়ন, নীতিমালা সংশোধন, বন্যপ্রাণীবান্ধব সড়ক নির্মাণ এবং প্রাকৃতিক ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্প।
ফলাফল: সঠিক বিনিয়োগে টিকে থাকবে বেশিরভাগ প্রজাতি
গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে ১৩৩টি প্রজাতির মধ্যে ১৩০টিরই ২০৫০ সালের মধ্যে টিকে থাকার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের কম।
কিন্তু যখন সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপগুলো পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তখন ফলাফল অনেক উন্নত হয়। বছরে ১১.৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগে ১৬টির মধ্যে ১৫টি প্রজাতি গোষ্ঠীর টিকে থাকার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে যায়।

WWF–এর মতামত ও সামাজিক গুরুত্ব
জেমস স্নাইডার, WWF কানাডার বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন বিষয়ক সহ–সভাপতি, বলেন—“আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও আবাসন চাহিদার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। বর্তমানে অনাবাদী জমিকে পুনরুজ্জীবিত করাই এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
তিনি আরও জানান, এই প্রস্তাবিত ব্যয় অন্টারিওর বার্ষিক বাজেটের এক শতাংশেরও কম—প্রতি নাগরিকের জন্য বছরে গড়ে প্রায় ৭ ডলার।
গবেষণায় দেখা গেছে, জনসাধারণ এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে রাজি, এমনকি একটি মাত্র প্রজাতিকেও বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে হলে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আহ্বান
গুয়েলফের সংরক্ষণ বিজ্ঞানী ড্যান ক্রাউস, যিনি গবেষণাটিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, বলেন—“আমরা বহুদিন ধরেই প্রকৃতির মূল্য ও সংরক্ষণ ব্যয়কে অবমূল্যায়ন করে আসছি। এখন সময় এসেছে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার।”
তিনি আরও বলেন, এই বিনিয়োগ শুধু প্রাণবৈচিত্র্যই নয়, বরং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, এবং মানুষের সামগ্রিক সুস্থতা–তেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গবেষণাটি দেখায়, সঠিক কৌশল ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ অন্টারিওর বিপন্ন প্রজাতিগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। এটি শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ নয়—বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার রূপরেখা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















