সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে আবার সরে এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের আপত্তির মুখে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নও উঠছে।
‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫’ নামে গত ২৮শে অগাস্ট জারি করা গেজেটে এই দুটি পদে নিয়োগের বিষয় উল্লেখ থাকলেও রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব স্বাক্ষরিত সংশোধিত প্রজ্ঞাপনে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা পদ দুটি রাখা হয়নি।
সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা আসার পর থেকেই এ নিয়ে আপত্তি জানাতে শুরু করে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে নানা কর্মসূচিও পালন করে তারা। এছাড়া সংগীত শিক্ষকের বদলে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের দাবিও জানানো হয়।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের অনেকে বলছেন, এসব সংগঠনের চাপে পড়ে ঝামেলা এড়াতে সরকার হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। কিন্তু এর মাধ্যমে একটি নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি হলো।
যদিও সিদ্ধান্তটি কেন বাতিল করা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বিবিসি বাংলাকে তার একান্ত সচিব জানান, এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন উপদেষ্টা।
তবে রাত পৌনে নয়টার দিকে এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, যদিও সরকার প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু ‘এত অল্প সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে কার্যকর কোনো সুফল বয়ে আনবে না এবং এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে’। তাই পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।
এর আগে এ বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, কওমি মাদ্রাসার যোগ্য শিক্ষার্থীদেরও যাতে প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছেন তিনি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বরাত দিয়ে মি হোসেন বলেন, “তিনি আমাকে বলেছেন, প্রাথমিকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেয়ার সুযোগ নেই, জেনারেল শিক্ষার্থীরা আবেদন করবেন তারা শিগগিরই ৩২ হাজার শিক্ষক নেবেন। আলাদা বিষয়ভিত্তিক কোন শিক্ষক নেয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই।”

এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যেভাবে
শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে লেখাপড়ার অংশ হয়ে আছে সংগীত, চারু ও কারুকলা এবং শারীরিক শিক্ষা।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুদের মন ও মননের যথার্থ বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের এমন আলোচনার প্রেক্ষিতে গতানুগতিক লেখাপড়ার বাইরে সৃজনশীল পঠন এবং শারীরিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকিকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০ সালে।
ওই বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ও বিকাশ’ শিরোনামে একটি কর্মসূচিও হাতে নিয়েছিল সরকার।
২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নির্দেশিকায় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সংগীত বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, “মানবিক গুণাবলি বিকাশের জন্য সংগীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।”
এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো পাঠ্যপুস্তক না থাকলেও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসের জন্য আলাদা সংগীত ও স্বরলিপির নির্দেশনাও দেওয়া হয় ওই শিক্ষক নির্দেশিকায়। শারীরিক শিক্ষা বিষয়েও একইভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল ওই সময়।
পরবর্তীতে ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগে একটি প্রস্তাব তৈরি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
যার ভিত্তিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই দুই বিষয়ে ৫ হাজার ১৬৬ জন শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাবে সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত থাকার পর গত ২৮শে অগাস্ট চারটি পদের নাম উল্লেখ করে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’– প্রণয়ন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
যেখানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পাশাপাশি সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদের নিয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়।

কেন এবং কারা বিরোধিতা করছে
সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় আসার পর থেকেই এ নিয়ে বিরোধিতা শুরু করে কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন। বিশেষ করে সংগীত শিক্ষক বাতিলের দাবিতে নানা কর্মসূচিও পালন করে তারা।
সম্প্রতি ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’ এ দুটি পদে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করার পর থেকে সক্রিয় হয় কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন।
পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও।
গত ১৬ই সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সেমিনারে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক পাঁচটি দলের নেতারা বলেন, মানসিক ও আদর্শিক ঘাটতি রেখে লেখাপড়ার মূল লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগ না দিয়ে সরকার গানের শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে।
সংগীত শিক্ষকের পরিবর্তে সরকারকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়ারও দাবি জানায় তারা। এমনকি এই সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে রাজপথে আন্দোলনেরও হুমকি দেয় তারা।
এমন প্রেক্ষাপটে, বিধিমালায় সংশোধন এনে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করল সরকার। যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদ রেখে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার পদ দুটি বাতিল করা হয়েছে।
যদিও সরকারের এই সিদ্ধান্তেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতারা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় নেতা কে এম শরীয়তউল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করলেই হবে না, প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
মি. শরীয়তউল্লাহ বলছেন, “বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যার যার নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করবে। সংগীত কোনো ম্যান্ডাটরি শিক্ষা হতে পারে না কিন্তু ধর্ম শিক্ষা না থাকার কারণে মানুষর মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়”।

বাতিলের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হয়নি
সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগীত ও শারিরীক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিলের সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হয়নি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা। তাদের অনেকেই বলছেন, কোন বিবেচনায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি বোধগম্য নয়।
সরকার কেন বা কী কারণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে ইসলামপন্থি কিছু সংগঠনের আপত্তির পরে এই পরিবর্তন আসায় অনেকেই যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছেন।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে যদি কোনো গোষ্ঠির চাপে পড়ে সরকার সেটি পরিবর্তন করে থাকে, তাহলে সেটি ভালো উদাহরণ নয় বলেও তারা মনে করেন।
শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলছেন, “এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ধর্ম এবং সংস্কৃতি চর্চাকে আমরা একটা সংঘর্ষের জায়াগায় নিয়ে গেলাম, এই বিষয়টি এখানে বিবেচনা করা হয়নি।”
“সরকার এরকম সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং ধর্ম, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা সব বিষয়কে একসাথে নিয়েই এগোতে পারতো,” বলছেন মিজ চৌধুরী।
এছাড়া এর মাধ্যমে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল, এই সিদ্ধান্ত বাতিলের মাধ্যমে সেটিও বন্ধ করা হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
এক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষের দাবির ভিত্তিতে নয় বরং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকার একটি কার্যকর সিদ্ধান্ত পৌছাতে পারত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মনিনুর রশিদ।
তিনি বলছেন, “সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন কোন গবেষণার ভিত্তিতে নেয়া হয়েছিল, আবার যখন বাদ দিল তখন কোন যু্ক্তিতে বাদ দিল, এর কোনটাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”
এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই গবেষণা ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ।
সরকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে
এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা ও প্রতিবেদন হওয়ায় মঙ্গলবার রাত পৗেনে নয়টার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং থেকে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, ”সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৫০০ ক্লাস্টারে সমসংখ্যক শরীর চর্চা শিক্ষক ও সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সম্প্রতি সচিব কমিটির সুপারিশে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।”
প্রেস উইংয়ের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ”সচিব কমিটি মনে করে, প্রকল্পটির পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। এত অল্প সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে কার্যকর কোনো সুফল বয়ে আনবে না এবং এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।”
”সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫ শত ৬৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই প্রস্তাবিত নিয়োগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। ক্লাস্টার ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হলে একই শিক্ষককে ২০টির অধিক বিদ্যালয়ে যুগপৎভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর ফলে তার পক্ষে কর্মঘণ্টা ম্যানেজ করা সম্ভব হবে না বলে সচিব কমিটি মনে করে।”
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ”পরবর্তীকালে অর্থের সংস্থান-সাপেক্ষে সকল স্কুলে এরকম নতুন বিষয়ের শিক্ষকের পদ সৃজন এবং সেসব পদে নিয়োগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে কমিটি অভিমত ব্যক্ত করেছে।”
বিবিসি নিউজ বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















