প্রকৃতির অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞান
মাটির নিচে বিস্তৃত এক বিশাল ছত্রাক জালকে বলে ‘মাইসেলিয়াম’। এই জালের মাধ্যমে ছত্রাক প্রকৃতিতে পুষ্টি বিনিময় করে এবং সময়মতো মাশরুম জন্ম দেয়। এবার সেই মাইসেলিয়ামই হয়ে উঠছে আলাস্কার ঘরবাড়ির তাপ নিরোধক বা ইনসুলেশনের নতুন উপাদান।
আলাস্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়াবহ হয়ে উঠেছে—বরফ গলছে, বন্যা বাড়ছে, মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে, আর ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় নিরাপদ, উষ্ণ ও সাশ্রয়ী বাসস্থানের চাহিদা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
ছত্রাক নিরোধকের উদ্ভাবন
ন্যাশনাল রিনিউএবল এনার্জি ল্যাবরেটরি ও ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কার বিজ্ঞানীরা একসাথে কাজ করছেন প্রকৃতিনির্ভর এক নতুন নিরোধক তৈরিতে।
আলাস্কার তাপমাত্রা পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়—ইউকন ফ্ল্যাটস অঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ৭৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত নেমে যায়, আর গ্রীষ্মে পৌঁছায় ১০০ ডিগ্রি পর্যন্ত। এই চরম তাপমাত্রা ঘর গরম রাখার খরচ বাড়িয়ে দেয়। অপর্যাপ্ত ইনসুলেশন ও বায়ু চলাচলের অভাবে ছত্রাক, স্যাঁতস্যাঁতে ভাব ও দূষিত বায়ুর সমস্যা দেখা দেয়।
সাধারণত মানুষ প্লাস্টিকের নিরোধক ব্যবহার করে—যা ঘরকে ‘প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো’ বাড়িতে পরিণত করে বলে মন্তব্য করেন ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কার ছত্রাকবিজ্ঞানী ফিলিপ আমস্টিস্লাভস্কি।
স্থানীয় সম্পদ থেকে টেকসই বিকল্প
আমস্টিস্লাভস্কি ও তাঁর দল স্থানীয় কাঠের গুঁড়া ও দেশীয় ছত্রাক ব্যবহার করে নতুন এক প্রকার নিরোধক তৈরি করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, আলাস্কার গ্রামীণ এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য তুন্দ্রা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাই তিনি এমন কিছু তৈরি করতে চাইলেন যা প্রকৃতির সম্পদ ব্যবহার করে প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে।
তিনি বলেন, মাছ প্যাকেট করা কিংবা ঘর নিরোধকের জন্য যে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, তা শেষ পর্যন্ত নদী, উপকূল ও সাগরে গিয়ে দূষণ সৃষ্টি করে।
ছত্রাক গবেষণার সূচনা
আমস্টিস্লাভস্কি ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কায় একটি বায়োমেটেরিয়াল ল্যাব গড়ে তোলেন এবং ছত্রাক ও অণুজীব নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। জলরোধী, হালকা উপাদান খুঁজতে গিয়ে তাঁর শৈশবের ছত্রাক সংগ্রহের অভিজ্ঞতা আবার মনে পড়ে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী ছোটবেলায় বাবা-মা, যাঁরা দুজনেই জীববিজ্ঞানী, তাঁদের সঙ্গে বনজঙ্গলে ছত্রাক ও বেরি সংগ্রহ করতেন। এই প্রেরণাই তাঁকে বনজ জৈব পদার্থ থেকে স্টাইরোফোমের মতো নিরোধক তৈরি করতে উৎসাহ দেয়।
চরম তাপমাত্রায় পরীক্ষা
আমস্টিস্লাভস্কি যুক্ত হন ন্যাশনাল রিনিউএবল এনার্জি ল্যাবরেটরির গবেষক রবিন গারবার-স্লাগ্টের সঙ্গে। তাঁরা আলাস্কার ফেয়ারব্যাঙ্কসে একটি মোবাইল টেস্ট ল্যাব বানান—একটি ছোট বাড়ির মতো কাঠামো, যার দেয়ালে বিভিন্ন নিরোধক উপকরণ স্থাপন করে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরীক্ষা করা হয়।
গারবার-স্লাগ্ট বলেন, “শীতে ল্যাবের ভেতরটা এতটাই উষ্ণ ও আর্দ্র যে সেখানে থাকা বেশ আরামদায়ক।”
মৃত বৃক্ষ ও ছত্রাকের সংমিশ্রণ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আলাস্কায় বিটল সংক্রমণে প্রচুর স্প্রুস গাছ মারা গেছে। আমস্টিস্লাভস্কি এই মৃত গাছকেই “ছত্রাকের খাদ্যভান্ডার” হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও কমে।
বিভিন্ন ছত্রাকের মধ্যে তাঁরা অবশেষে এমন এক “সুপার ফাঙ্গাস” খুঁজে পান, যা যে কোনো কাঠের গুঁড়াতেই বেড়ে উঠতে পারে। প্রথমদিকে উপাদানটি ভঙ্গুর ছিল, দেখতে কাঠের গুঁড়ো ও ছত্রাকের মিশ্রণের মতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা একে উন্নত করে তৈরি করেন শক্ত, টেকসই বোর্ড যা ১০০% পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব।
তৈরি প্রক্রিয়া
বিজ্ঞানীরা কাঠের গুঁড়া, পানি ও ছত্রাক মিশিয়ে একটি ঘন তরল তৈরি করেন, যা ছাঁচে ঢেলে ‘ইনকিউবেটর’-এ রাখা হয়। সেখানে ছত্রাক বেড়ে ওঠে, এরপর তাপে শুকিয়ে শক্ত বোর্ডে পরিণত করা হয়।
এই বোর্ডগুলো হালকা, শ্বাস-প্রশ্বাসযোগ্য, জলরোধী এবং তাপ ধরে রাখার ক্ষমতায় প্রায় প্লাস্টিক নিরোধকের সমান।
টেকসই ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বার্কলির গবেষক লিনিং ইয়াও এই উদ্ভাবনকে স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সাশ্রয়ী বলেছেন, যদিও তিনি উল্লেখ করেন যে, সম্পূর্ণ জৈব উপাদান প্লাস্টিকের মতো দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
তবে গারবার-স্লাগ্ট ও আমস্টিস্লাভস্কির নয় বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে—এই নিরোধক বোর্ডে কোনো ছত্রাক জন্মায়নি এবং এটি আগের মতোই কার্যকর রয়েছে।
আমস্টিস্লাভস্কি বলেন, “এটি একদিকে যেমন টেকসই ইনসুলেশন উপাদান, তেমনি কার্বন শোষণের প্রাকৃতিক মাধ্যমও হতে পারে।”
তাঁদের লক্ষ্য, উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে পুরো প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ কার্বন-নিরপেক্ষ করা।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
বিজ্ঞানীরা চান তাদের এই ছত্রাক নিরোধক বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে পড়ুক। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে মাছ পরিবহনে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বাক্সের বিকল্প হিসেবে।
গারবার-স্লাগ্ট বলেন, “আমাদের স্বপ্ন—একদিন আমরা সম্পূর্ণ ছত্রাক দিয়ে পুরো একটি বাড়ি ‘বাড়িয়ে তুলব’। যদিও এখনও সে পথে অনেকটা বাকি।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















