রাসায়নিকের সংস্পর্শে জীবনভর প্রভাব
নিউইয়র্কের রোচেস্টারে ডেভিড তোথ ও তার বোন ছোটবেলায় বাবার ড্রাই-ক্লিনিং ব্যবসায় কাজ করতেন। সেই সময় তাঁরা নিয়মিত একধরনের রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসতেন — পারক্লোরোইথিলিন (PCE), যা কাপড় পরিষ্কারে ব্যবহৃত হয়। কয়েক দশক পর দু’জনেই পারকিনসন রোগে আক্রান্ত হন। তোথ বলেন, “সেই গন্ধ সবসময় লেগে থাকত। আমি প্রায় সারাক্ষণই এর আশপাশে ছিলাম।” চিকিৎসকেরা জানান, এই রাসায়নিকের সংস্পর্শই তাঁদের অসুস্থতার মূল কারণ হতে পারে।
পারকিনসন: দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া স্নায়বিক রোগ
বিশ্বজুড়ে পারকিনসন এখন দ্রুত বাড়ছে, তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, এটি প্রতিরোধযোগ্যও। নিউইয়র্কের এট্রিয়া হেলথ অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ড. রে ডরসি বলেন, “রোগটির মূল উৎস আমাদের ভেতরে নয়, বরং বাইরের পরিবেশে — আমাদের খাবার, পানি ও বাতাসে থাকা রাসায়নিকেই ঝুঁকি লুকিয়ে আছে।”
এই রোগ মূলত ডোপামিন উৎপাদনকারী মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট করে ফেলে, যার ফলে শরীরের চলাফেরায় প্রভাব পড়ে — হাতে কম্পন, পেশির শক্তভাব, গতি কমে যাওয়া ও ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

জেনেটিক নয়, বড় কারণ পরিবেশ
‘ব্রেইন’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মাত্র ১৩ শতাংশ আমেরিকানের মধ্যে জেনেটিক ঝুঁকি দেখা গেছে। বাকিদের ক্ষেত্রে রোগের কারণ পরিবেশঘটিত। অর্থাৎ দূষণ, কীটনাশক, শিল্পকারখানার রাসায়নিক — এসবই বড় ভূমিকা রাখছে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করছেন, একে অতিরিক্ত সরলীকৃতভাবে দেখা ঠিক নয়। ফিনিক্সের ব্যারো নিউরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. ব্র্যাড র্যাকেট বলেন, “একটি মাত্র দূষণ কমিয়ে দিলে আমরা পুরো পারকিনসন প্রতিরোধ করতে পারব — এটা ভাবা ভুল। অনেক কারণ মিলেই এই রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়।”
মেয়ো ক্লিনিকের অধ্যাপক ড. রোডলফো সাভিকা যোগ করেন, “ঝুঁকি থাকা মানেই যে কেউ রোগে আক্রান্ত হবেন, এমন নয়। পরিবেশের কিছু ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান আমরা পরিবর্তন করতে পারি, তবে সবকিছুই কেবল সেই কারণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।”
কীভাবে ঝুঁকি কমানো যায়
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশগত কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে পারকিনসনের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
১. বসবাসের স্থান সম্পর্কে সচেতন হোন
গলফ কোর্স বা দূষিত শিল্প এলাকা (Superfund site)-এর কাছে বসবাস এড়িয়ে চলুন। ‘জামা নেটওয়ার্ক ওপেন’-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গলফ কোর্সের এক মাইলের মধ্যে বসবাসকারীদের পারকিনসন ঝুঁকি ১২৬% বেশি। গলফ কোর্সে ব্যবহৃত কীটনাশক — যেমন ক্লোরপাইরিফস — এর সঙ্গে রোগের সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

২. ড্রাই-ক্লিনিং রাসায়নিকের সংস্পর্শ কমান
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ধীরে ধীরে PCE ব্যবহারের অনুমতি তুলে নিচ্ছে, ২০৩৪ সালের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আরেকটি রাসায়নিক TCE ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ। যদি ড্রাই-ক্লিনারের উপরে বাস করেন, তবে সতর্ক থাকুন — সেখানে বাতাসে বিষাক্ত রাসায়নিকের মাত্রা বেশি থাকতে পারে। কাপড় পরিষ্কারের পর বাড়িতে আনার আগে একদিন খোলা জায়গায় ঝুলিয়ে রাখুন।
৩. পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিন
দূষিত বায়ু পারকিনসনের অন্যতম ঝুঁকি। ড. র্যাকেট পরামর্শ দেন, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। ড. ডরসি বলেন, শহরে বসবাসকারীরা যেন কার্বন ফিল্টারযুক্ত এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করেন — এগুলো বাতাসে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক শোষণ করে।
৪. বিশুদ্ধ পানি পান করুন
যদি ব্যক্তিগত কূপের পানি ব্যবহার করেন, তবে তা নিয়মিত পরীক্ষা করুন। কীটনাশক বা অন্যান্য রাসায়নিক মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইপিএ অনুমোদিত ল্যাব থেকে পরীক্ষা করানো যেতে পারে। কার্বন ফিল্টারযুক্ত জলের ফিল্টারও কার্যকর।
৫. কীটনাশকের সংস্পর্শ কমান
প্যারাকুয়াট নামের আগাছানাশক অনেক দেশে নিষিদ্ধ, তবে যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘদিনের সংস্পর্শ পারকিনসনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ড. ডরসি বলেন, “নিজের আঙিনায় বা বাগানে কী স্প্রে করছেন, সে বিষয়ে সচেতন থাকুন।”
পারকিনসন রোগের প্রকৃত কারণ জটিল, তবে পরিবেশগত প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। সঠিক জীবনযাপন, সচেতনতা ও পরিবেশবান্ধব অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা অন্তত ঝুঁকিটা কিছুটা হলেও কমাতে পারি।
#স্বাস্থ্য #পারকিনসন #পরিবেশদূষণ #রাসায়নিকঝুঁকি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















