ক্ষুদ্র জগতে এক রাজকীয় সৌন্দর্য
আমস্টারডামের রাইক্সমিউজিয়ামের প্রদর্শনী কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি—পেট্রোনেলা ওর্টমানের পুতুলবাড়ি। এই পুতুলবাড়ি কেবল শিশুদের জন্য নয়, বরং সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ অভিজাত জীবনের এক অনন্য দলিল। ক্ষুদ্র কাপ-প্লেট, সিল্ক পর্দা, মার্বেল মেঝে—সবই তৈরি হয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজে, তিন শতাধিক বছর আগে।
ওর্টমানের এই পুতুলবাড়িতে থাকা ক্ষুদ্রতম চায়ের কাপটি আকারে এক পিনের চেয়েও ছোট, আর বড়তম থালাটি আধা ইঞ্চির বেশি নয়। তবে প্রতিটি উপকরণই তৈরি হয়েছিল দক্ষ কারিগরের হাতে।
বিলাসিতার প্রতীক পুতুলবাড়ি
এই পুতুলবাড়িটি তৈরি ও সাজাতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩০,০০০ গিল্ডার—যা সেই সময়ের একটি বাস্তব প্রাসাদের দামের সমান। রাইক্সমিউজিয়ামের আসবাবপত্র কিউরেটর আলেক্সান্ডার ডেনচারের ভাষায়, “এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বিলাসবহুল পুতুলবাড়ি।”
১৬৮৬ থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে, একজন ধনী রেশম ব্যবসায়ীর স্ত্রী পেট্রোনেলা ওর্টমান তাঁর স্বপ্নের এই ক্ষুদ্র প্রাসাদটি সাজান। চারপোস্টের বিছানা, সিল্কের পর্দা, মখমলের কুশন, সূচিকর্ম করা দেয়াল ও মার্বেল মেঝে—সবই সেখানে নিখুঁতভাবে উপস্থিত। এমনকি গৃহস্থালির কাজের জন্য তিনি ২৩টি ক্ষুদ্র ঝুড়িও যুক্ত করেছিলেন।

প্রদর্শনীতে নতুন জীবন
সাধারণত রাইক্সমিউজিয়ামের স্থায়ী প্রদর্শনীর অংশ হলেও, বর্তমানে এই পুতুলবাড়ি স্থান পেয়েছে “At Home in the 17th Century” প্রদর্শনীতে, যা জানুয়ারি ১১ পর্যন্ত চলবে।
প্রদর্শনীর প্রধান কিউরেটর সারা ভান ডাইক বলেন, “চিত্রশিল্পী ইয়ান স্টিন বা ভারমিয়ারের কাজগুলো ডাচ জীবনের আদর্শচিত্র দেখালেও, এই পুতুলবাড়ি আমাদের দেখায় বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি—যেমনটা সত্যি ছিল।”
রাইক্সমিউজিয়ামের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগ্রহগুলোর মধ্যে এই পুতুলবাড়ি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, “The Night Watch”-এর পরেই।
সাহিত্য ও শিল্পে অনুপ্রেরণা
২০০৯ সালে ব্রিটিশ লেখিকা জেসি বার্টন এই পুতুলবাড়ি দেখে অনুপ্রাণিত হন এবং লেখেন বিখ্যাত উপন্যাস The Miniaturist (২০১৪)। ওর্টমানের জীবনী সংক্রান্ত তেমন তথ্য না থাকলেও, বার্টন কল্পনার জগতে সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন। তাঁর মতে, “ওর্টমান এমন এক সমাজে বাস করতেন, যেখানে তিনি অর্থ ব্যয় করতেন এমন জিনিসে—যা তিনি কখনো ব্যবহারই করতেন না।”
তিন ‘পেট্রোনেলা’-র পুতুলবাড়ি
সপ্তদশ শতাব্দীর মাত্র তিনটি পুতুলবাড়ি আজও টিকে আছে—এবং কাকতালীয়ভাবে তিনটির মালিকই ছিলেন পেট্রোনেলা নামের নারী।
রাইক্সমিউজিয়ামে প্রদর্শিত দুটি হলো ওর্টমানের ও পেট্রোনেলা ডুনোয়িসের পুতুলবাড়ি (১৬৭৬ সালের কাছাকাছি), আর তৃতীয়টি পেট্রোনেলা দে লা কুর-এর, যা সংরক্ষিত আছে উট্রেখটের সেন্ট্রাল মিউজিয়ামে।

ওর্টমান যখন তাঁর পুতুলবাড়ি তৈরি করান, তাঁর বয়স ছিল ৩০। কাঠমিস্ত্রি এটি তৈরি করেন তিন বছরে—ওক কাঠ ও টারটয়শেল দিয়ে। নির্মাণকালীন সময় তিনি ওর্টমানের বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন।
নারীর গৃহজগতের প্রতিচ্ছবি
ওর্টমানের স্বামী জোহানেস ব্রান্ট বাড়ির সামনের অংশে রেশমের দোকান চালাতেন। সে সময় ডাচ পুরুষরা বৈদেশিক পণ্য নিয়ে “ওয়ান্ডারক্যামের” বা “কিউরিওসিটির কেবিনেট” তৈরি করতেন, আর নারীরা তৈরি করতেন পুতুলবাড়ি—যেখানে ক্ষুদ্র জগতে ফুটে উঠত গোটা সমাজের প্রতিচ্ছবি।
ওর্টমান তাঁর বাড়ি সাজিয়েছিলেন স্থানীয় রুপকারিগরদের তৈরি ক্ষুদ্র রূপপাত্র, ভারতের ও আফ্রিকার শামুকের খোল, এবং চীন-জাপানের পোরসেলিন সামগ্রী দিয়ে।
ভান ডাইক বলেন, “সেই সময় পরিবারকেই সমাজের ক্ষুদ্রতম একক মনে করা হতো, আর গৃহকর্ত্রী ছিলেন তার কেন্দ্রবিন্দু। এই পুতুলবাড়ি আসলে নারীর সেই জগতের প্রতীক।”
জীবনের গল্প এক ক্ষুদ্র ঘরে
ওর্টমান অতিথিদের তাঁর পুতুলবাড়ি দেখাতে ভালোবাসতেন। তিনি পর্দা সরিয়ে প্রতিটি কক্ষ দেখাতেন, আলমারি খুলে দেখাতেন ক্ষুদ্র কাপড়, সিল্ক ও মৃৎপাত্র।
একসময় এই বাড়িতে ২৭টি ক্ষুদ্র পুতুল ছিল—গৃহপরিচারিকা থেকে শুরু করে শিশুসহ পরিবারের প্রতীক হিসেবে। এখন টিকে আছে মাত্র একটি—সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক শিশুপুতুল, যা লাল আর্মচেয়ারে বসানো আছে।
১৭১০ সালের এক চিত্রে দেখা যায়, পুতুলবাড়ির একটি ঘরে দুই পুরুষ পুতুল বোর্ড গেম খেলছে, আরেক ঘরে কয়েকজন শিশু দাঁড়িয়ে আছে এক শিশুর কফিনের পাশে।
ভান ডাইক বলেন, “এই পুতুলবাড়ি জীবন ও মৃত্যুর গল্প বলে—একই সঙ্গে জন্ম, পরিবার ও বিদায়ের চিত্র তুলে ধরে।”

ইতিহাসের জীবন্ত দলিল
রাইক্সমিউজিয়ামের কিউরেটর ডেনচারের মতে, “এই পুতুলবাড়ি আমাদের দেখায় কীভাবে সেই সময়ের অভিজাত গৃহ পরিচালিত হতো। এখানে রান্নাঘর থেকে শুরু করে ধোপার ঘর পর্যন্ত সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো, যেন বাস্তব ঘরেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ।”
ঝাড়ন, বালতি, ঝুড়ি থেকে শুরু করে মখমলের সোফা পর্যন্ত—সবকিছুই সূক্ষ্ম যত্নে সাজানো। এটি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং এক ঐতিহাসিক দলিল, যা ডাচ সমাজে নারীর ভূমিকা, গৃহজীবন এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটায়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট
#ডাচ_পুতুলবাড়ি #রাইক্সমিউজিয়াম #PetronellaOortman #TheMiniaturist #ডাচ_ইতিহাস #Amsterdam #DutchArt #MiniatureHouse #সপ্তদশ_শতাব্দী #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















