শিশুদের হাতে প্রযুক্তির বীজ
অ্যারিজোনার ফিনিক্সে সম্প্রতি খোলা হয়েছে ‘সেমি কোয়েস্ট’ নামে একটি বিশেষ শিক্ষা পার্ক। সেখানে শিশুদের চিপ উৎপাদন প্রক্রিয়া শেখানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে খেলাধুলার মাধ্যমে শেখার পরিবেশ। বৃষ্টিভেজা এক সকালে শিশুদের হাসি আর উল্লাসে মুখর ছিল অ্যারিজোনা সায়েন্স সেন্টার। কেউ মাইক্রোস্কোপে চিপ পর্যবেক্ষণ করছে, কেউ আবার সাদা ‘বানী স্যুট’ পরে সেমিকন্ডাক্টর ক্লিনরুমে কাজের অভিনয় করছে।
এই উদ্যোগের লক্ষ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চিপ শিল্পের প্রতি আগ্রহী করা—যে শিল্প এখন আমেরিকার প্রযুক্তিনির্ভর পুনর্জাগরণের কেন্দ্রে। কোভিড-১৯ মহামারিতে সরবরাহব্যবস্থার বিপর্যয় এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বানে এই পরিবর্তন আরও গতি পেয়েছে।
অ্যারিজোনার সেমিকন্ডাক্টর উত্থান
টিএসএমসি (TSMC)-এর ১৬৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের নেতৃত্বে অ্যারিজোনায় ইতোমধ্যে ৬০টিরও বেশি সেমিকন্ডাক্টর সম্প্রসারণ প্রকল্প গড়ে উঠেছে, যার মোট মূল্য ২১০ বিলিয়ন ডলার। এতে ২৫,০০০ নতুন চাকরির সৃষ্টি হয়েছে।
অ্যারিজোনা কমার্স অথরিটির সভাপতি স্যান্ড্রা ওয়াটসন বলেন, “এই গতি ধরে রাখতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা জরুরি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রকৌশল জ্ঞানে শিক্ষিত করতে হবে।”

তবে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শুধুমাত্র চিপ শিল্পেই ৬৭,০০০ দক্ষ কর্মীর ঘাটতি দেখা দেবে। আর সামগ্রিক অর্থনীতিতে ঘাটতি হবে প্রায় ১৪ লাখ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মী তৈরির হিড়িক
অ্যারিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়ার কমিউনিটি কলেজগুলো দ্রুত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে। সিয়েরা কলেজের মেকাট্রনিক্স প্রোগ্রাম—যেখানে যান্ত্রিক প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিক্স শেখানো হয়—বড় বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। জার্মান কোম্পানি বোশ, ১.৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে ক্যালিফোর্নিয়ায়, যা গত ৩০ বছরে সবচেয়ে বড় সেমিকন্ডাক্টর বিনিয়োগ।
সিয়েরা কলেজের অধ্যাপক রয় ইঙ্গ্রাম বলেন, “চাহিদা এত বেশি যে অনেক ছাত্র দুই সেমিস্টারও শেষ করার আগেই উচ্চ বেতনের চাকরি পাচ্ছে।”
মারিকোপা কমিউনিটি কলেজও ৩ বছরে ১,২০০ শিক্ষার্থীকে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে প্রস্তুত করেছে, যেখানে ইন্টেল ও টিএসএমসি সরাসরি অংশীদার।
কিন্তু এআই আসছে—মানবশ্রমের ভবিষ্যৎ কোথায়?
একদিকে যখন সরকার ও কোম্পানিগুলো মানবসম্পদ তৈরিতে বিনিয়োগ করছে, অন্যদিকে এআই ও রোবোটিকস দ্রুত কাজের ধরন বদলে দিচ্ছে।
এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বলেন, ‘ভবিষ্যতের কারখানা হবে এক বিশাল রোবট, যা অন্য রোবটদের দ্বারা রোবট তৈরি করবে।’

তিনি দাবি করেন, রোবট মানুষের চাকরি নেবে না, বরং তাদের সহকর্মী হবে। কিন্তু বাস্তবে ২০২৫ সালেই ২১৮টি প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে ১,১২,০০০-এর বেশি কর্মী ছাঁটাই হয়েছে।
সরবরাহ চেইন কোম্পানি ‘অ্যাটলাস নেটওয়ার্ক’-এর সিইও কেরিম কফুরি বলেন, “আমেরিকায় উৎপাদন টিকে থাকবে তখনই, যখন তা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হবে।”
এআই কি চাকরির হুমকি না আশীর্বাদ?
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এআই চাকরি কমাবে না, বরং নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করবে। মাইক্রনের এক প্রযুক্তি কর্মকর্তা বলেন, “যদি আপনি এআই শেখেন, এটি আপনার কাজকে আরও শক্তিশালী করবে। না শিখলে কেউ না কেউ শিখবে এবং আপনার চাকরিটি সে পেয়ে যাবে।”
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—যখন আজকের শিশুরা বড় হবে, তখনওকি তাদের জন্য এই চাকরিগুলো থাকবে? সেমির ভাইস প্রেসিডেন্ট শেরি লিস বলেন, “আমরা এখনও জানি না। তবে যতদিন কারখানাগুলোতে মানুষ দরকার, ততদিন আমাদের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু রাখতে হবে।”
অভিবাসন নীতির কাঁটায় ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা
ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি দক্ষ কর্মী ভিসা (H1B)-এর আবেদন ফিতে ১ লাখ ডলার বাড়িয়েছে, যা টেক শিল্পে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

এনভিডিয়ার হুয়াং বলেন, “এই নীতি আমাদের মতো অভিবাসী পরিবারকে কখনও যুক্তরাষ্ট্রে আসতে দিত না। যদি আমেরিকা দক্ষ অভিবাসীদের আকর্ষণ না করতে পারে, তবে এআই প্রতিযোগিতায় চীন এগিয়ে যাবে।”
একই সময়ে চীন তাদের নতুন K1 ভিসা চালু করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের আকৃষ্ট করতে। এতে অনেক গবেষক ও শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের কথা ভাবছেন।
অভিবাসন অভিযান ও ভয়ের পরিবেশ
আইসিই (ICE) কর্তৃক জর্জিয়ায় হুন্ডাই-এলজি ব্যাটারি কারখানায় অভিযান চালিয়ে শত শত কর্মীকে গ্রেফতারের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক। সিয়েরা কলেজে শ্রেণিকক্ষে পোস্টার ঝুলছে—‘ইমিগ্রেশন অফিসার এলে শান্ত থাকুন ও নিরাপত্তাকর্মীকে জানান।’
অধ্যাপক ইঙ্গ্রাম বলেন, “এ ধরনের সতর্কবার্তা বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা অনুভব করতে সাহায্য করে।”
আমেরিকা একদিকে শিল্প পুনর্জাগরণে প্রযুক্তি কর্মী তৈরিতে ছুটছে, অন্যদিকে এআই ও কঠোর অভিবাসন নীতির বাস্তবতা সেই প্রচেষ্টাকে অনিশ্চিত করে তুলছে। প্রশ্ন এখন একটাই—আগামী দিনের কারখানায় মানুষের জায়গা থাকবে, নাকি রোবটই হবে নতুন শ্রমিক?
#প্রযুক্তি #এআই #আমেরিকা #চাকরি #অভিবাসননীতি #সেমিকন্ডাক্টর #শিল্পপুনর্জাগরণ #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















