আলোর মাধ্যমে ভাস্কর্যের ছোঁয়া
আমরা সাধারণত ঘরে ঢুকেই আলো জ্বালাই, কিন্তু আলো জ্বালানোর পর চোখ খুব কমই ওপরে ওঠে। মার্কিন আলোক-ডিজাইনার লিন্ডসি অ্যাডেলম্যানের সৃষ্টিকর্ম এই অভ্যাসটিকে বদলে দিয়েছে। তাঁর হাতে তৈরি ঝাড়বাতি ও আলোকসজ্জা কেবল আলো নয়—এগুলো যেন একেকটি জীবন্ত ভাস্কর্য।
অ্যাডেলম্যানের ভাষায়, “আমার আলোর ডিজাইন স্বভাবতই ভাস্কর্যশিল্পের মতো প্রকাশভঙ্গি ধারণ করে। এটিকে মাটির বা জায়গার সীমাবদ্ধতায় বাঁধা যায় না।”
কারিগরি থেকে খ্যাতির শিখরে
লিন্ডসি অ্যাডেলম্যানের পথচলা সরল ছিল না। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে তিনি স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে সম্পাদকীয় সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। একদিন জাদুঘরের কারিগরদের কাজ করতে দেখে তাঁর জীবন বদলে যায়—যা দেখে তিনি বুঝলেন যে তিনিও এমন সৃষ্টিশীল কাজ করতে চান।
এরপর তিনি রোড আইল্যান্ড স্কুল অব ডিজাইনে ভর্তি হন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানেই তিনি সূক্ষ্ম কারুশিল্প ও প্রযুক্তিগত নিখুঁততার সমন্বয় শিখেন—যা পরবর্তীতে তাঁর কাজের পরিচয় হয়ে ওঠে।
আলো ডিজাইনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
২০০৫ সালে অ্যাডেলম্যান আধুনিক আলোর প্রচলিত উপকরণ—ধাতব পাইপ, কাচ ও সংযোগ যন্ত্রাংশ—নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এক বছর পর তিনি তৈরি করেন ‘ব্রাঞ্চিং বাবল’ ঝাড়বাতি, যেখানে ধাতব কাঠামোর শাখাগুলো হাতে তৈরি কাচের বুদ্বুদ আকৃতির ছায়া ধারণ করে। এই ঝাড়বাতিই তাঁর খ্যাতির সূচনা করে।

শিল্প ও প্রকৌশলের মেলবন্ধন
নিউইয়র্কে নিজের স্টুডিওতে ৫৭ বছর বয়সী অ্যাডেলম্যান ও তাঁর দল প্রতিনিয়ত ধাতুর রঙ, রাসায়নিক বিক্রিয়া ও কাচের কারিগরি নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর ‘ড্রপ সিস্টেম’ ঝাড়বাতিতে ডাচ শিল্পী পিয়েত মন্ড্রিয়ানের জ্যামিতিক রেখা থেকে প্রেরণা নেওয়া হয়েছে। এতে হাতে পালিশ করা ব্রাস ও কাচের গোলকগুলো একত্রে তৈরি করে দারুণ স্থাপত্যশীলতার অনুভব তৈরি করে। ৭৬ বাল্বের এই ঝাড়বাতির দাম শুরু হয় প্রায় ৯১,০০০ ডলার থেকে।
অ্যাডেলম্যান বলেন, “আলো ডিজাইন আসলে এক ধরনের সেবা—যেখানে সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়েই শিল্পের জন্ম হয়।”
বিশ্বজুড়ে প্রদর্শনী ও স্বীকৃতি
তাঁর আলোকসজ্জা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে, যেমন মিলানের ‘নিলুফার গ্যালারি’ এবং প্যারিসের ‘ট্রিওড ডিজাইন গ্যালারি’। নিউইয়র্কের ‘দ্য ফিউচার পারফেক্ট’ গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড আলহাদেফ বলেন, “লিন্ডসি শুধু আলো তৈরি করেন না, তিনি আমাদের আলো দেখার দৃষ্টিও বদলে দেন।”
নতুন সৃষ্টিতে ঐতিহ্যের ছোঁয়া
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে অ্যাডেলম্যান উন্মোচন করেন তাঁর ‘ওভারগ্লো’ পেন্ডেন্ট লাইট সংগ্রহ। এটি ১৬শ শতকের ভেনিসের খাঁচাবদ্ধ কাচের রাস্তার আলো থেকে অনুপ্রাণিত। প্রতিটি পেন্ডেন্টে থাকে মুখে ফুঁ দিয়ে তৈরি বালিশের মতো গোলক, যা ধাতব ফ্রেমের ভেতর থেকে ফুলে উঠেছে বলে মনে হয়।
অ্যাডেলম্যান বলেন, “এই কৌশলটা ছিল বেশ মজার—প্রচলিত নকশার সঙ্গে পরীক্ষামূলক উপাদানের মিলন।”

প্রযুক্তি নয়, নান্দনিকতাই মুখ্য
যখন অনেকে স্মার্ট লাইটিং প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন, অ্যাডেলম্যান বেছে নিয়েছেন সূক্ষ্মতার পথ। তাঁর মতে, “এলইডি এখন অনেক সুন্দর রঙ তাপমাত্রায় পাওয়া যায়, যা আলোর সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যেতে পারে।”
আন্তর্জাতিক আলোক ডিজাইনার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রিয়া হার্টরানফ্ট বলেন, “আলোক ডিজাইনাররা শিল্প ও বিজ্ঞানের সংযোগস্থলে কাজ করেন। এখনকার উন্নত প্রযুক্তি আলোকে আরও সৃষ্টিশীলভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ দিচ্ছে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: গুণমানের অগ্রাধিকার
আগামী বসন্তে অ্যাডেলম্যান উন্মোচন করবেন তাঁর নতুন সিরিজ ‘অ্যান্ড্রোমেডা’। এতে মার্বেলের পাতলা স্তর ধাতুর উপর বসিয়ে কোমল ও মৃদু আলো তৈরি করা হবে। তবে, বিশ্বব্যাপী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তিনি আগামী বছর থেকে উৎপাদন সীমিত করতে চান। তাঁর ভাষায়, “আমি সবসময় পরিমাণের চেয়ে গুণমানকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি।”
আলো, অনুভূতি ও শিল্প
লিন্ডসি অ্যাডেলম্যানের কাছে আলো কেবল একটি প্রযুক্তিগত উপাদান নয়—এটি এক অনুভূতির প্রতীক। আলো, গতি ও কল্পনার সংমিশ্রণে তিনি প্রমাণ করেছেন আলোকসজ্জাও হতে পারে শিল্পের এক অনন্য মাধ্যম। দুই দশক পরও তিনি এখনও সেই প্রথম স্ফুলিঙ্গটির পেছনে ছুটছেন—যাই একসময় তাঁর জীবন আলোকিত করেছিল।
#লিন্ডসি_অ্যাডেলম্যান
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















