মানবিক দৃষ্টিতে এক কিংবদন্তি প্রযোজক
হলিউডের কিংবদন্তি প্রযোজক জন ল্যান্ডাউ (১৯৬০–২০২৪) তার শেষ জীবনের দিকে লিখেছিলেন স্মৃতিকথা “দ্য বিগার পিকচার”, যেখানে তিনি নিজের কর্মজীবনের পাশাপাশি জীবনের দর্শনও তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি পরিবারকে বলেছিলেন, “হলিউডে হয়তো আমাকে সবচেয়ে সফল প্রযোজক হিসেবে মনে রাখা হবে না, কিন্তু আমি চাই, আমাকে সবচেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে মনে রাখা হোক।” এই বাক্যেই ল্যান্ডাউয়ের বিনয় ও মধুর স্বভাবের পরিচয় মেলে—যা চলচ্চিত্র জগতে খুবই বিরল।
তিনটি সর্বাধিক আয়কারী ছবির প্রযোজক
যদিও ল্যান্ডাউ নিজেকে সাধারণ মানুষ ভাবতেন, বাস্তবে তিনি প্রযোজনা করেছেন বিশ্বের তিনটি সর্বাধিক আয়কারী চলচ্চিত্র—“টাইটানিক” (১৯৯৭), “অ্যাভাটার” (২০০৯) এবং “অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার” (২০২২)। এই তিনটি ছবিই পরিচালক জেমস ক্যামেরন-এর সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সহযোগিতার ফল। ক্যামেরনের সঙ্গে ল্যান্ডাউয়ের সম্পর্ক ছিল শুধু পেশাদার নয়, বরং গভীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মানের।
প্রযোজনার পেছনের মানুষটি
“অ্যাভাটার”-এর শুটিং সেটে ল্যান্ডাউ ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক এক মানুষ। সাংবাদিকদের তিনি নিয়ে যেতেন সেই বিশাল প্রযোজনা ঘরে, যেখানে তরুণরা কম্পিউটারে গড়ে তুলছিল কল্পনার জগৎ—প্যান্ডোরা। “টাইটানিক”-এর বিশাল জাহাজ নির্মাণের মতোই “অ্যাভাটার”-এর ভার্চুয়াল জগৎ গড়ে তোলায় তার উৎসাহ ছিল অপরিসীম।
ক্যামেরনের প্রতি তার সমর্থন ছিল অটল। বইতেও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, ক্যামেরনের সবচেয়ে বড় সহযোগী ও রক্ষাকবচ ছিলেন জন ল্যান্ডাউ।
আত্মজীবনী নাকি অনুপ্রেরণার বই
জেমস ক্যামেরন নিজেই লিখেছেন “দ্য বিগার পিকচার”-এর ভূমিকাংশ। সেখানে যেমন হলিউডের বাস্তব দিক উঠে এসেছে—যেখানে শিল্প নয়, লাভকেই সাফল্য হিসেবে দেখা হয়—তেমনি ল্যান্ডাউয়ের বইটিও কিছুটা আত্মোন্নয়নমূলক পাঠের মতো। এতে তিনি পরিবার, বিশেষ করে স্ত্রী জুলি-র প্রতি তার গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন।
তবে বইটি শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি বড় বাজেটের সিনেমা নির্মাণ প্রক্রিয়ার এক নস্টালজিক জানালাও।
‘টাইটানিক’-এর নেপথ্যের গল্প
ল্যান্ডাউ জানান, “টাইটানিক” ছবির সেটে জাহাজের শুধুমাত্র ডানদিক (স্টারবোর্ড) তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস অনুযায়ী ডকের অবস্থান ছিল বামদিকে (পোর্ট সাইডে)। সমস্যার সমাধান হয়েছিল এক অভিনব উপায়ে—জাহাজের নাম ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ উল্টো করে লিখে সেটের ছবিটি নেগেটিভ ফ্লিপ করে দেওয়া হয়। আজ হয়তো এটি সফটওয়্যারে করা যেত, কিন্তু তখনকার সময়ে এটি ছিল এক বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল।
সমালোচনা নয়, প্রশংসাই মুখ্য
ল্যান্ডাউ ছিলেন স্বভাবগতভাবে ভদ্র ও ইতিবাচক মানুষ। তাই অনেক জায়গায় তিনি সমালোচনা এড়িয়ে গেছেন। যদিও তার কিছু লেখায় সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পায় অন্তর্নিহিত রাগ বা হতাশা।
উদাহরণস্বরূপ, পরিচালক ডেভিড ফিঞ্চার সম্পর্কে তিনি লেখেন, “তার মধ্যে ছিল প্রচণ্ড আবেগ,”—যা অনেক সময় কষ্টকর ছিল। অভিনেত্রী শন ইয়াং সম্পর্কেও তিনি উল্লেখ করেন, “ডিক ট্রেসি”-তে তার অতিরিক্ত আকর্ষণীয় উপস্থিতি গল্পের ভারসাম্য নষ্ট করেছিল।
হারানো সুযোগ ও অনুতাপ
ল্যান্ডাউ সবচেয়ে বেশি আফসোস করেন “ডেড পোয়েটস সোসাইটি” (১৯৮৯) প্রযোজনা করতে না পারায়। অভিনেতা ডাস্টিন হফম্যান স্ক্রিপ্টটি পছন্দ করার ভান করে সময় নষ্ট করেন, ফলে অন্য অভিনেতারা সরে যান। পরে হফম্যান শর্ত দেন, তিনি ছবিতে অভিনয় করবেন এবং পরিচালনাও করবেন—এতে প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়।
পারিবারিক প্রভাব ও পেশাদার দর্শন
ল্যান্ডাউয়ের বাবা-মা, এডি ও এলি ল্যান্ডাউ, ছিলেন স্বাধীনধারার প্রযোজক, যাদের কাজের মধ্যে ছিল “কিং: এ ফিল্মড রেকর্ড… মন্টগোমারি টু মেমফিস” (১৯৭০)। তাদের জীবনদর্শন—“সবার আগে আসো, সবার শেষে যাও”—ল্যান্ডাউয়ের নিজের কর্মজীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
সহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতি
ল্যান্ডাউ পরিচালক মাইকেল ম্যান এবং প্রযোজক জোয়েল সিলভার সম্পর্কেও প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন, যদিও তারা অনেক সময় জটিল স্বভাবের ছিলেন। তার ভাষায়, “কমপক্ষে তাদের সঙ্গে আপনি জানতেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন।”
জেমস ক্যামেরনের প্রতি অনুগত সহযোগী
সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি বরাদ্দ রেখেছেন ক্যামেরনের জন্য। যখন “টাইটানিক” নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের সমালোচক কেনেথ তুরান বিতর্কিত পর্যালোচনা লিখেছিলেন, ক্যামেরন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। ল্যান্ডাউ বিষয়টি নিয়ে শুধু বলেন, “জিম রিভিউ নিয়ে, রিভিউয়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে, এবং প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া নিয়েও লিখেছিলেন।”
ল্যান্ডাউয়ের মতে, ‘ভদ্র মানুষ’ হওয়াও এক ধরনের ত্যাগ—সব কথা সব সময় বলা যায় না।
“দ্য বিগার পিকচার” শুধু একটি প্রযোজকের স্মৃতিকথা নয়, বরং হলিউডের ভেতরের দুনিয়ার এক মানবিক প্রতিফলন। জন ল্যান্ডাউ হয়তো নিজেকে সবচেয়ে বড় প্রযোজক ভাবতেন না, কিন্তু তার কাজ, বিনয় এবং মানবিকতা তাকে আলাদা করে রেখেছে—একজন সাফল্যনির্ভর ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে ভালো মানুষ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















