বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (NICU) ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ছত্রাক ‘ক্যান্ডিডা অরিস’। নতুন এক আইসিডিডিআরবি গবেষণায় দেখা গেছে, এই ছত্রাক দ্রুত সংক্রমিত হয়ে নবজাতকদের জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
স্বাস্থ্যখাতে নতুন হুমকি: হাসপাতাল-সম্পর্কিত ছত্রাক সংক্রমণ
ঢাকা, বাংলাদেশ, ৯ নভেম্বর ২০২৫ — স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত সংক্রমণ (HAIs) বিশ্বজুড়ে এক বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ‘ক্যান্ডিডা অরিস’ নামের এক প্রাণঘাতী ছত্রাক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে (LMICs) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আইসিডিডিআরবি (ICDDR,B) পরিচালিত নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ছত্রাক বাংলাদেশের বিভিন্ন নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (NICU) সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সাময়িকী Microbiology Spectrum-এ। এটি পরিচালনা করেছে আইসিডিডিআরবি ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IEDCR), যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC)-এর প্রযুক্তিগত সহায়তায়।
প্রাণঘাতী ছত্রাক ‘ক্যান্ডিডা অরিস’: নিঃশব্দ সংক্রমণ থেকে মৃত্যুহার পর্যন্ত
‘ক্যান্ডিডা অরিস’ এমন এক ছত্রাক, যা প্রথমে ত্বকে অবস্থান করে কোনো উপসর্গ ছাড়াই থেকে যায়। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি ত্বক থেকে শরীরের ভেতরে, বিশেষ করে রক্তে, প্রবেশ করে গুরুতর সংক্রমণ সৃষ্টি করে। একবার শরীরে প্রবেশ করলে এর মৃত্যুহার প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, বিশেষ করে দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা নবজাতকের ক্ষেত্রে।
এটি বহু অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী, যা একে পরিণত করেছে এক ‘সুপারবাগ’-এ। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) এটিকে জরুরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধী হুমকি হিসেবে ঘোষণা করে। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি হাসপাতালের পরিবেশে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে, দ্রুত ছড়ায় এবং উচ্চমাত্রার মৃত্যুহার ঘটায়।
গবেষণার বিবরণ: ঢাকা শহরের দুটি হাসপাতাল থেকে তথ্য
২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরের একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে গবেষকরা ৩৭৪ জন নবজাতক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন।
ফলাফলে দেখা যায়—
- মোট ৩২ জন (৯%) নবজাতক ‘ক্যান্ডিডা অরিস’-এ সংক্রমিত হন।
- এর মধ্যে ১ জন (০.৩%) রক্তে সংক্রমণ (ব্লাডস্ট্রিম ইনফেকশন/রক্তপ্রবাহ সংক্রমণ) বিকাশ করেন।
- সংক্রমিতদের মধ্যে ৪৪% ভর্তি হওয়ার সময়ই সংক্রমিত ছিলেন।
- বাকি ৫৬% ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালের ভেতরে সংক্রমিত হন।

সংক্রমিত নবজাতকদের মধ্যে সাতজনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে রক্তে সংক্রমণ হওয়া শিশুটিও ছিল। গবেষকরা মনে করছেন, হাসপাতালের অভ্যন্তরেই এই ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটছে, এবং ভর্তি-পরবর্তী সংক্রমণ তার প্রমাণ।
আরেকটি সাম্প্রতিক আইসিডিডিআরবি গবেষণায়ও দেখা গেছে, নবভর্তি রোগীদের মধ্যে কমিউনিটি-নির্ভর ‘ক্যান্ডিডা অরিস’ সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। ফলে হাসপাতালকেন্দ্রিক সংক্রমণের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রতিরোধ ও সিজারিয়ানের সংযোগ
বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে—
- মাত্র ৩টি (৯%) ‘ক্যান্ডিডা অরিস’ নমুনা একাধিক ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী ছিল।
- ৮২% নমুনা ‘ফ্লুকোনাজোল’ নামের সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী।
- সংক্রমিত নবজাতকদের মধ্যে ৮১% শিশুর জন্ম সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে হয়েছে।
দীর্ঘ হাসপাতাল অবস্থান হয়তো, তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞের মন্তব্য: প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি
আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) গবেষণা ইউনিটের প্রধান ও সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন,
“এই গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে গুরুতর অসুস্থ শিশুদের মধ্যে এই সুপারবাগ দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ।”
প্রতিরোধমূলক সুপারিশ
গবেষকরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন—
- ক্লোরিন-ভিত্তিক জীবাণুনাশক দিয়ে নিয়মিত হাসপাতালের পৃষ্ঠতল পরিষ্কার রাখা।
- চিকিৎসাকর্মীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়ানো।
- নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (NICU) সংক্রমণের ক্রমাগত নজরদারি চালু করা।
- সংক্রমিত বা আক্রান্ত নবজাতককে দ্রুত পৃথকীকরণ এবং দ্রুত অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা প্রদান।
আইসিডিডিআরবি
বাংলাদেশ ভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যগবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি গত ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জনস্বাস্থ্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা তথ্য ও অভিজ্ঞতা নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়তা করছে।
#স্বাস্থ্য #বাংলাদেশ #আইসিডিডিআরবি #ক্যান্ডিডাঅরিস #NICU #সুপারবাগ #সংক্রমণ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















