বিতর্কের সূচনা
থাইল্যান্ডে এক মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগীর সঙ্গে অবমাননাকর আচরণের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে নতুন করে আলোচনা।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, নাওয়াত ইৎসারাগ্রিসিল, থাইল্যান্ডের মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল (MGI) সংস্থার প্রেসিডেন্ট, মেক্সিকোর প্রতিযোগী ফাতিমা বস-এর ওপর রাগ প্রকাশ করছেন। এই ঘটনার প্রেক্ষাপট—এ মাসের শেষের দিকে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ৭৪তম মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা।
‘তুমি কথা বলার সুযোগ পাওনি’
একটি লাইভ অনুষ্ঠানে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সামনেই নাওয়াত অভিযোগ করেন, ফাতিমা নাকি থাইল্যান্ডের পক্ষে যথেষ্ট প্রচারণা চালাচ্ছেন না। তিনি এমনকি ইঙ্গিত দেন যে, মেক্সিকোর পেজেন্ট পরিচালক তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচারণা নষ্ট করতে বলেছেন।
ফাতিমা প্রতিক্রিয়া জানালে নাওয়াত তাকে থামিয়ে দেন এবং বলেন, “আমি তোমাকে কথা বলার সুযোগ দিইনি।” এরপর তিনি নিরাপত্তারক্ষীদের ডেকে তাকে কক্ষ থেকে বের করে দিতে বলেন।
এই সময় অন্যান্য প্রতিযোগীরা প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে পড়েন ও একসঙ্গে বেরিয়ে আসেন। এতে ক্ষুব্ধ নাওয়াত হুমকি দেন, তারা বসে না গেলে সবাইকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হবে।
বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও মেক্সিকো প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর নাওয়াতের আচরণের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম এই ঘটনাকে “আক্রমণাত্মক আচরণ” বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, “বস এই পরিস্থিতি মর্যাদার সঙ্গে সামলেছেন।”
তিনি বলেন, “নারীরা যেন নির্ভয়ে নিজেদের কণ্ঠ তুলে ধরতে পারেন, সেটিই এই ঘটনার শিক্ষণীয় দিক।” প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন, মেক্সিকোতে প্রচলিত একটি যৌনবাদী প্রবাদ হলো—“চুপ থাকলে মেয়েরা আরও সুন্দর দেখায়।” এর জবাবে তিনি বলেন, “না, নারীরা আরও সুন্দর যখন তারা নিজেদের কণ্ঠ তোলে এবং সমাজে অংশ নেয়।”
বসের বক্তব্য: ‘আমরা শক্তিশালী নারী’
মিস ইউনিভার্স মেক্সিকো ফাতিমা বস পরে এক ভিডিওতে বলেন, “তিনি (নাওয়াত) আমাকে চুপ থাকতে বলেছেন এবং অনেক অপমানজনক কথা বলেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, সারা বিশ্বকে এটা দেখা উচিত—আমরা শক্তিশালী নারী, এবং এই মঞ্চ আমাদের কণ্ঠের জায়গা। কেউ আমাদের কণ্ঠ বন্ধ করতে পারবে না।”
তিনি আরও জানান, থাই কর্মকর্তার এই আচরণের পেছনে নাওয়াত ও মিস ইউনিভার্স সংগঠনের মধ্যে থাকা মতবিরোধই মূল কারণ।
সংস্থার পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ
মিস ইউনিভার্স সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রাউল রোচা, যিনি নিজেও মেক্সিকান, ঘটনাটির পর নাওয়াতের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ সীমিত করে দেন। রোচা বলেন, “একজন নিরস্ত্র নারীকে ভয় দেখাতে নিরাপত্তারক্ষী ডেকে এনে অপমান করা এক ধরনের গুরুতর নির্যাতন।”
তিনি ঘোষণা করেন, “৭৪তম মিস ইউনিভার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে নাওয়াতের অংশগ্রহণ যতটা সম্ভব সীমিত করা হয়েছে বা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে।”
পরে নাওয়াত একটি অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আমার কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি সত্যিই দুঃখিত।”
নারীবাদী বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
কলম্বিয়ান নারীবাদী লেখক কাতালিনা রুইজ নাভারো, যিনি মেক্সিকো সিটিতে থাকেন, বলেন, “এই ধরনের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা মূলত নারীদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলিত করার একটি পিতৃতান্ত্রিক ধারণার প্রতিফলন।”
তবে তিনি ফাতিমা বসের সাহসের প্রশংসা করেন—“তার আচরণ অত্যন্ত সাহসী। কারণ সে অনেক কিছু হারাতে পারত। তবুও প্রতিবাদ করেছে, এবং তার সঙ্গে অন্য মেয়েরাও বেরিয়ে গেছে—এটা সম্মিলিত ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি।”
‘মুকুট নয়, মর্যাদা গুরুত্বপূর্ণ’
গত বছরের মিস ইউনিভার্স বিজয়ী শেইনিস প্যালাসিওস (নিকারাগুয়া) সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “একটি মুকুট কখনোই নারীর মর্যাদার বিনিময়ে অর্জিত হওয়া উচিত নয়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এই প্রতিযোগিতাগুলো নারীর নেতৃত্ব ও প্রেরণার জায়গা হওয়া উচিত। কিন্তু যখন এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার বা অসম্মান ঘটে, তখন এর উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়।”
১৯৯৬ সালের মিস ইউনিভার্স বিজয়ী অ্যালিসিয়া মাচাডো (ভেনেজুয়েলা) বলেন, “এই ধরনের অনৈতিক আচরণ প্রতিযোগিতার ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করে। সময় এসেছে, এই মঞ্চ নারীর অধিকার ও সমতার পক্ষে লড়াইয়ের মাধ্যম হয়ে উঠুক।”
সামনে কী?
রুইজ নাভারোর মতে, বস ও অন্যান্য প্রতিযোগীদের সাহসী অবস্থান ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “যতদিন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা থাকবে, ততদিন এগুলোকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য ও মর্যাদাপূর্ণ হতে হবে।”
৭৪তম মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার কার্যক্রম ইতিমধ্যেই ব্যাংককে শুরু হয়েছে। ১৩০টি দেশের প্রতিযোগী এতে অংশ নিচ্ছেন। আগামী ২১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ফাইনাল অনুষ্ঠান ও বিজয়ীর অভিষেক।
#MissUniverse #Mexico #Thailand #FatimaBosch #WomenEmpowerment #GenderEquality #SarakkhonReport
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















