রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সুইদা প্রদেশে বেদুইনদের নির্বাসন
সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সুইদা প্রদেশে জুলাই মাসে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বেদুইনদের উপস্থিতি। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তারা নিজেদের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা, সে আশা প্রায় নিঃশেষ।
বেদুইন পরিবারগুলো জানিয়েছে, ড্রুজ মিলিশিয়ারা তাদের ধরে নিয়ে যায় এবং একটি স্কুলে বন্দি করে রাখে। তিন দিন পর পাহারাদাররা চলে গেলে পালানোর চেষ্টা করেন তারা। গুলি ছোঁড়া হলে অনেকে প্রাণ হারান। ফয়সাল সবিহের পরিবারও এ সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আর তার ২০ বছর বয়সী কন্যা মালাক পরদিন বিয়ের আগেই গুলিতে নিহত হন।
ফয়সাল অভিযোগ করেন, শীর্ষ ড্রুজ ধর্মীয় নেতা শেখ হিকমত আল-হাজারির অনুগত বাহিনী সুন্নি মুসলিম বেদুইনদের প্রদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তার মতো আরও অনেকে রয়টার্সকে জানান, একসময় শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করা দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক এখন সম্পূর্ণ ছিন্ন।
সহিংসতার ভয়াবহতা ও প্রাণহানি
রয়টার্সের তথ্যমতে, মাত্র এক সপ্তাহের সংঘর্ষে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই ড্রুজ সম্প্রদায়ের। কয়েক দশকের সহাবস্থান ভেঙে পড়ে। বেদুইনরা এখন পাশের দারাআ প্রদেশে কৃষকের জমিতে কাজ করে কোনোভাবে বেঁচে আছে।
ফয়সাল বলেন, লেবাননে ১৭ বছর পরিশ্রম করে তিনি সুইদায় একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। সবকিছু মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেছে।

দুই পক্ষের পারস্পরিক অভিযোগ
ড্রুজ নেতারা দাবি করেছেন, তারা বেদুইন পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্থানীয় এক মিলিশিয়া কমান্ডার তার বিপরীতে বলেন, বেদুইনরা “সুইদার শরীরে ক্যানসারের মতো” এবং তাদের ফেরার প্রশ্নই আসে না।
তবে শেখ হিকমত আল-হাজারির কার্যালয় জানিয়েছে, তিনি বেদুইনদের ওপর হামলা নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতেন। কিন্তু সরকারি বাহিনী প্রদেশ ছাড়ার পর তারাও চলে যায়, এমনটাই বলা হয়েছে সেই বিবৃতিতে।
অন্যদিকে, সিরিয়ার তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সহিংসতায় সব পক্ষই নির্যাতন চালিয়েছে। অনেক বেদুইন পালিয়েছে কারণ হাজারি-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো তাদের এলাকায় আক্রমণ করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল।
সরকারের প্রতিশ্রুতি ও শান্তি পরিকল্পনা
বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাআ—যিনি এক সময় আল-কায়েদা-সমর্থিত বিদ্রোহী নেতা ছিলেন—প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ড্রুজ সম্প্রদায়কে সুরক্ষিত রাখতে সরকার পদক্ষেপ নেবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের মধ্যস্থতায় সেপ্টেম্বরে ১৩ দফা শান্তি রূপরেখা গৃহীত হয়েছে, যাতে বাস্তুচ্যুত মানুষদের ঘরে ফেরানোর অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু হাজারি-সমর্থিত স্থানীয় প্রশাসন ওই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে স্বশাসনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পটভূমি
ড্রুজ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ১১শ শতাব্দীতে ইসলামের এক শাখা থেকে, এবং সিরিয়ায় তাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ—মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। কিছু চরমপন্থী মুসলিম গোষ্ঠী তাদের ধর্মদ্রোহী বলে মনে করে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত জুলাইয়ের মাঝামাঝি, যখন এক ড্রুজ ব্যবসায়ীকে রাজধানীর পথে অপহরণ করা হয়। দায় দেওয়া হয় বেদুইনদের ওপর, এরপর শুরু হয় পাল্টা অপহরণ, সহিংসতা ও রক্তপাত।

ইসরায়েল ও অন্যান্য পক্ষের ভূমিকা
ইসরায়েলও ঘটনাপ্রবাহে যুক্ত হয়, তাদের দেশীয় ড্রুজ জনগোষ্ঠীর চাপের মুখে সিরিয়ার ড্রুজদের রক্ষার দাবি তুলে। সরকারি বাহিনী, ড্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে, যতক্ষণ না একটি মার্কিন-সমর্থিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
বন্দিদশা ও ভিডিও প্রমাণ
রয়টার্স যাচাই করেছে এমন দুটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ড্রুজরা বেদুইন পরিবারগুলোকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেও হুমকিও দেয়—“তোমাদের কেউ বেঁচে থাকবে না।” এই দৃশ্যগুলোই ফয়সাল সবিহ ও তার পরিবারের বন্দিদশার সত্যতা তুলে ধরে।
বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ পরিসংখ্যান
সরকারি হিসাবে, জুলাইয়ের সংঘর্ষে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ড্রুজ এবং ৭০ হাজার বেদুইন ঘরছাড়া হয়। বেশিরভাগ ড্রুজ রয়ে গেছে সুইদায়, কিন্তু প্রায় সব বেদুইন অন্য প্রদেশে পালিয়েছে।
ড্রুজ যোদ্ধারা এখন প্রদেশের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণে। দুই পক্ষই অভিযোগ করছে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাট ও দখল করা হয়েছে।
পুনর্বাসন ও অনিশ্চয়তা
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা আলোচনার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে এবং কিছু অগ্রগতি হয়েছে, যেমন খাদ্য সাহায্য, বাণিজ্য পুনরুদ্ধার ও বন্দি বিনিময়। কিন্তু হাজারির স্বাধীনতার দাবি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেদুইনদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা জরুরি। হাজারি সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপে রাজি নন, কারণ তিনি এটিকে “চরমপন্থী মতাদর্শের” সরকার বলে অভিহিত করেছেন।

হারানো জীবন, হারানো আশা
ফয়সাল ও তার স্ত্রী ফাসলা এখনো কন্যা মালাকের মৃতদেহ খুঁজে পেতে চান, কিন্তু ভয়ে এগোতে পারেন না। ফাসলা বলেন, পালানোর সময় মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়, পরে আলাদা ট্রাকে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুর খবর আসে।
ফয়সাল এখনো শোকে আচ্ছন্ন। লেবাননে বছরের পর বছর কাজ করে যে বাড়ি বানিয়েছিলেন, পশুপালন ও চাষবাসে যে জীবন গড়ে তুলেছিলেন, সবকিছুই মুহূর্তে শেষ হয়ে গেছে।
তার কণ্ঠে নিঃশেষ কষ্টের সুর—“আমরা কীভাবে ফিরে যাব? তারা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।”
#সিরিয়া #বেদুইন #ড্রুজ #ধর্মীয়সহিংসতা #সুইদা #বাস্তুচ্যুতি #সংঘর্ষ #মধ্যপ্রাচ্য
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















