শুরুর কথা
বাংলাদেশের ছোট পর্দার এক উজ্জ্বল মুখ তানজিন তিশা। মডেলিং দিয়ে শুরু করা এক তরুণীর আজকের এই সাফল্যের গল্প কেবল একজন অভিনেত্রীর নয়, বরং এক নারীর আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম ও আত্মনির্ভরতার কাহিনি। টেলিভিশনের পর্দা থেকে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম, এবং এখন বড় পর্দায় পদচারণার স্বপ্ন—সব মিলিয়ে তিশার জীবন এক অনুপ্রেরণার যাত্রা।
শৈশব ও পারিবারিক জীবনের শুরু
তানজিন নাহার তিশার জন্ম ঢাকায়। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, মা একজন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল নাচ, গান ও অভিনয়ে। স্কুলজীবনে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নাচ ও মডেলিং শিখেছিলেন, যা পরবর্তী জীবনে কাজে লেগেছে। পরিবারের পরিবেশ ছিল শিল্পপ্রেমী। তিশা ছোটবেলা থেকেই আয়নায় নিজের মুখভঙ্গি অনুশীলন করতেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—“আমি ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, একদিন টেলিভিশনে কাজ করব। কিন্তু জানতাম না, সেটা এত তাড়াতাড়ি ঘটবে।”
মডেলিংয়ের সূচনা (২০১১–২০১৩)
২০১১ সালে তিশা প্রথমবারের মতো র্যাম্পে হাঁটেন। ফ্যাশন হাউস ও বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ শুরু করেন। তাঁর চেহারার আকর্ষণ, ভঙ্গিমা ও আত্মবিশ্বাস দ্রুতই নজর কাড়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের। ২০১২ সালে একটি মোবাইল অপারেটরের বিজ্ঞাপনে কাজ করে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। এই বিজ্ঞাপনই তাঁর ক্যারিয়ারে বড় পরিবর্তন আনে। এরপর একের পর এক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, ফটোশুট ও র্যাম্প শোতে অংশ নিতে থাকেন। মডেলিং তাঁকে ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে। তাঁর হাসি, চোখের ভাষা আর সংলাপের ছন্দ পর্দায় বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে।

অভিনয়ে প্রথম পদচারণা ও বড় সাফল্য (২০১৪–২০১৫)
২০১৪ সাল তানজিন তিশার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এই বছর তিনি অভিনয় করেন নাটক “ইউ-টার্ন”-এ, যা তাঁর ক্যারিয়ারে এক মাইলফলক হয়ে ওঠে। গল্পে এক সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী তরুণীর চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন, যা দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। এই নাটক দিয়েই ছোট পর্দায় তিনি নিজের অবস্থান পাকা করে ফেলেন। সমালোচকরা বলেন—“নতুন মুখ হলেও অভিনয়ে তার পরিপক্বতা অসাধারণ।” ২০১৫ সালকে বলা যায় তিশার জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত বছর। এই বছর তিনি পরপর কয়েকটি সফল নাটকে অভিনয় করেন—“অমীমাংসিত সত্তা”, “মেঘ পাখি একা” এবং “এই শহরের মেয়েরা একা”—যা তাঁকে শুধু জনপ্রিয়ই করেনি, বরং তাঁর অভিনয়শৈলীর গভীরতাও প্রমাণ করেছে।
নাটকের বিশ্লেষণ
ইউ-টার্ন (২০১৪)
এই নাটকে তিশা ছিলেন এক তরুণী, যে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। অভিনয়ের গতি, সংলাপের উচ্চারণ ও চরিত্রের দৃঢ়তায় তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেন। এখান থেকেই তিনি নিজের জায়গা স্থায়ী করতে শুরু করেন।
অমীমাংসিত সত্তা (২০১৫)
এ নাটকে তিশা নিজের নামে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। গল্পে ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব ও মানসিক সংগ্রামের বিষয় উঠে আসে। চরিত্রে গভীর আবেগ ও সংবেদনশীলতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। দর্শকরা বলেন—“তিশা শুধু মুখ নয়, চোখ দিয়েই গল্প বলেন।”

মেঘ পাখি একা (২০১৫)
এ নাটকে তিনি এক নিঃসঙ্গ মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন, যে ভালোবাসা খোঁজে কিন্তু সমাজের সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে। তাঁর অভিনয়ে নীরব ব্যথা ও নিঃসঙ্গতার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
এই শহরের মেয়েরা একা (২০১৫)
এই নাটকে নগরীর মেয়েদের সংগ্রাম, স্বপ্ন আর বাস্তবতার গল্প বলা হয়। তিশা চরিত্রে ছিলেন দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী ও সমাজ সচেতন তরুণী হিসেবে। তাঁর সংলাপে ছিল প্রতিরোধের সুর।
আই অ্যাম সিঙ্গেল (২০২২)
এই আধুনিক নাটকে তিশা এক স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভর মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন, যে সমাজের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। তাঁর অভিনয় ছিল প্রাঞ্জল ও বাস্তবমুখী—যেন শহুরে মেয়েদের আত্মকথা।
পরিণত অভিনেত্রী হিসেবে বিকাশ (২০১৬–২০২১)
এই সময়টি তিশার জন্য ছিল প্রতিষ্ঠার সময়। তিনি ধারাবাহিক নাটকে নিয়মিত হতে থাকেন, টেলিফিল্মে অভিনয় করেন এবং ইউটিউবভিত্তিক প্রজেক্টেও যুক্ত হন। তাঁর অভিনয়ের ধরণে আসে পরিপক্বতা। তিনি শুধু রোমান্টিক নয়, ট্র্যাজিক ও সামাজিক নাটকেও কাজ করতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর অভিনীত কিছু জনপ্রিয় নাটক “তোমার আমার প্রেম”, “হৃদয়ের কথা” এবং “আমার শহরের বিকেল”—প্রত্যেকটিতেই ছিল নতুন উপস্থাপন ও অভিনয়ের গভীরতা।

মিউজিক ভিডিও ও বিশেষ প্রকল্প
তিশা শুধু নাটকেই নয়, মিউজিক ভিডিওতেও দর্শকদের কাছে প্রিয় মুখ। তাঁর অভিনীত জনপ্রিয় ভিডিওগুলোর মধ্যে রয়েছে “তোমাকে চাই”, “ভালোবাসা করে কয়” এবং “সত্যি বলছি”। এই ভিডিওগুলোতে তাঁর উপস্থিতি ছিল যেন সিনেমার দৃশ্য। আবেগ ও মূর্ছনায় তিনি গানকে জীবন্ত করে তোলেন।
চলচ্চিত্রে তিশা : বড় পর্দার নতুন স্বপ্ন
২০১৭ সালে তিনি “তুমি রবে নিরবে” চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এটি ছিল তাঁর প্রথম সিনেমা অভিজ্ঞতা। যদিও সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে বড় সাফল্য পায়নি, তবে তিশার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। এরপর কিছুদিন তিনি ছোট পর্দায় মন দেন। ২০২৩ সালে ওয়েব চলচ্চিত্র “পয়জন”-এ অভিনয় করে নতুনভাবে আলোচনায় আসেন। চরিত্রটি ছিল মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার ঘরানার, যেখানে তিনি এক নারীর মানসিক যন্ত্রণার রূপ ফুটিয়ে তোলেন। বর্তমানে তিনি বড় পর্দার একটি নতুন সিনেমায় কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন—“আমি এখন এমন চরিত্রে কাজ করতে চাই, যা সমাজকে প্রশ্ন করবে, দর্শককে ভাবাবে। সিনেমা এখন আমার পরবর্তী স্বপ্ন।”
ওয়েব সিরিজে পদার্পণ
২০২২ সালে ওয়েব সিরিজ “শিকল”-এর মাধ্যমে তিশা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে পা রাখেন। সেখানে তিনি এক জটিল, রোমাঞ্চকর চরিত্রে অভিনয় করেন। সিরিজটি দর্শকের প্রশংসা পায়, বিশেষ করে তাঁর অভিনয়ের গভীরতার জন্য। এরপর তিনি আরও কিছু ওয়েব প্রজেক্টে যুক্ত হন, যার মধ্যে রয়েছে “ডার্ক রুম” ও “একাত্তরের ছায়া” (চলমান)।
ব্যক্তিগত জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি

তানজিন তিশা খুব ব্যক্তিগত মানুষ। পরিবারকে গুরুত্ব দেন, নিজের সময়ের বড় অংশ কাটান মা-বাবার সঙ্গে। তিনি ধূমপান বা মদ্যপান করেন না, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পছন্দ করেন। ফিটনেস ও যোগব্যায়াম তাঁর নিত্য অভ্যাস। তিশা বলেন—“আমি যতটুকু জনপ্রিয়, তার চেয়ে বেশি দায়িত্ববান হতে চাই। একজন নারী শিল্পী হিসেবে সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চাই।” তিনি নারীর স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় বক্তব্য রাখেন।
জনপ্রিয়তা ও ব্র্যান্ড পরিচিতি
তানজিন তিশা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন তারকা। ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুসারী সংখ্যা লাখেরও বেশি। তিনি একাধিক ব্র্যান্ডের মুখ—ফ্যাশন, প্রসাধনী, মোবাইল অপারেটর ও জীবনধারা পণ্যে কাজ করেছেন। তাঁর স্টাইল ও উপস্থিতি তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। তিশা বলেন—“জনপ্রিয়তা ভালো লাগে, তবে আমি সবসময় চাই এটা কাজের জন্য আসুক, বাহ্যিক সাজের জন্য নয়।”
সংগ্রাম, চ্যালেঞ্জ ও আত্মনির্ভরতার পথ
অভিনয়ের জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সহজ নয়। শুরুতে তাঁকে অনেক প্রত্যাখ্যান, ভুল বোঝাবুঝি ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তিশা বলেন—“প্রথম দিকে অনেকে ভাবত, আমি শুধু সৌন্দর্যের কারণে আসছি। কিন্তু আমি নিজেকে প্রমাণ করেছি কাজের মাধ্যমে।” তিনি ধীরে ধীরে প্রমাণ করেছেন, অভিনয় শুধু সৌন্দর্যের খেলা নয়, বরং মেধা, অধ্যবসায় ও আন্তরিকতার সমন্বয়।
সমাজচেতনা ও মানবিকতা

তিশা বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত। শিশু শিক্ষা, নারী স্বাস্থ্য ও প্রাণী সুরক্ষায় তিনি কাজ করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন—একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের সমাজে দায়িত্ব আছে। তাঁর মতে—“আমরা যারা পর্দায় আছি, আমাদের কথায় অনেক মানুষ প্রভাবিত হয়। তাই আমাদের উচিত সচেতন বার্তা দেওয়া।”
অভিনয়ের দর্শন ও চরিত্র বাছাই
তিশার অভিনয়ের ধরন বাস্তবভিত্তিক। তিনি এমন চরিত্র বেছে নেন, যা দর্শকের মনে আলোড়ন তোলে। তাঁর ভাষায়—“চরিত্র যদি বাস্তব না হয়, অভিনয় করে মজা লাগে না। আমি চাই দর্শক আমার চরিত্রে নিজেদের খুঁজে পাক।” তিশার অভিনয়ে সংলাপের চেয়ে মুখভঙ্গি ও চোখের ভাষা বেশি প্রভাব ফেলতে দেখা যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ নিয়ে তিশার পরিকল্পনা স্পষ্ট—চলচ্চিত্রে স্থায়ী হওয়া, আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে কাজ করা এবং নিজের প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করা। বর্তমানে তিনি দুটি চলচ্চিত্র ও একটি আন্তর্জাতিক যৌথ প্রযোজনায় কাজের আলোচনা চালাচ্ছেন। তিশার স্বপ্ন—“আমি চাই, একদিন আমার কাজ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হবে, যেখানে লেখা থাকবে—‘বাংলাদেশ থেকে: তানজিন তিশা।’”
তানজিন তিশা কেবল একজন অভিনেত্রী নন, তিনি এক প্রতীক—যিনি প্রমাণ করেছেন যে প্রতিভা, অধ্যবসায় ও আত্মনির্ভরতা একত্রে থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়। মডেলিং থেকে নাটক, নাটক থেকে ওয়েব সিরিজ, এবং এখন চলচ্চিত্রে—তাঁর পথচলা এক আত্মবিশ্বাসী নারীর গল্প। আজ তিনি কেবল বাংলাদেশের টেলিভিশনের মুখ নন, বরং ভবিষ্যতের বড় পর্দার সম্ভাবনাময় নাম। তানজিন তিশা সেই আলোকিত মানুষ, যিনি জানেন—“সাফল্য মানে কখনো থেমে যাওয়া নয়, বরং প্রতিবার নতুনভাবে শুরু করা।”
#তানজিনতিশা #বাংলাদেশীনাটক #বাংলাদেশীচলচ্চিত্র #বাংলাদেশীঅভিনেত্রী #তানজিনতিশারজীবন #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















