০৩:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
ঢাকায় দিনের আলোয় গুলিতে নিহত একজন স্ট্রিমিং যুগে হলিউড: নাম নয়, কারিগরি ও ধারাবাহিকতা শিক্ষায় সরলীকৃত চীনা: অনমনীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজন বাস্তব সংস্কার মাইক্রো-ড্রামা: ছোট পর্বে পূর্ণ কাহিনি সমাধিক্ষেত্রের পদচিহ্নে ইতিহাস ও কল্পনার ছায়া যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উঠছে ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’ — ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা ঢাল নাকি এক মহাকল্পনার সাম্রাজ্য? তানজিন তিশা: আলো, প্রতিভা আর আত্মনির্ভরতার দীপ্ত গল্প জাপানের ট্রেডিং হাউসগুলো ট্রাম্পের শুল্ক চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলছে অ্যানথ্রপিকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবসা: ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি ও উদ্বেগ ক্যাটরিনা-ভিকির ঘরে নতুন অতিথি: পুত্রসন্তানের আগমনে বলিউডে আনন্দের বন্যা 

তানজানিয়ায় দমন-পীড়ন: রক্তে রাঙানো এক নতুন বাস্তবতা

উদ্বোধনের আড়ালে ভয় আর অনিশ্চয়তা

৩ নভেম্বর ২০২৫—তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামিয়া সুলুহু হাসানের শপথ অনুষ্ঠান ছিল এক বৈপরীত্যপূর্ণ দৃশ্য। মাত্র কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার দাবি করলেও, অভিষেক অনুষ্ঠানে আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন খুব কমই ছিল। অনুষ্ঠানটি হঠাৎ করেই রাজধানী দোদোমার সামরিক প্যারেড গ্রাউন্ডে সরিয়ে আনা হয়, জনসাধারণকে উপস্থিত থাকতে নিষেধ করা হয়, আর আফ্রিকার মাত্র চারজন রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত ছিলেন।

এই পরিবর্তনগুলো আসলে শাসক দল চামা চা মাপিন্দুজির (CCM) ভয়ের প্রতিফলন। নির্বাচনের পর তানজানিয়া জুড়ে যে বিক্ষোভ দেখা দেয়, তা দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জনআন্দোলন হয়ে ওঠে। বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে, নেতাদের কারাগারে পাঠিয়ে এবং ভোটের ফলাফল জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল CCM। কিন্তু জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব।


 গণতন্ত্রের দাবিতে তরুণদের উত্থান

নেপাল ও মাদাগাস্কারের পর তানজানিয়ায় তরুণ প্রজন্মের এই গণঅভ্যুত্থান অনেককে অবাক করেছে। নির্বাচনের আগে আফ্রোব্যারোমিটারের জরিপ অনুযায়ী, CCM তখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ২০২৫ সালে প্রায় ৬ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল।

তবে আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি অর্থনীতি নয়, গণতন্ত্রের দাবি। ব্রিটিশ গবেষক ড্যান পাগেটের মতে, তানজানিয়ার বিরোধী আন্দোলন নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন’ হিসেবে। বিরোধী দল চাদেমার কারাবন্দি নেতা টুন্ডু লিসু নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার স্লোগান ছিল: ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়।’

এই বছরই নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিরোধী দলের বহু কর্মী নিখোঁজ হয়েছে বলে অভিযোগ। ২০২১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির মৃত্যুর পর সামিয়া যখন ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে প্রেসিডেন্ট হন, তখন থেকেই তার শাসনকাঠামো আরও কঠোর হয়ে ওঠে।


 ইন্টারনেট বন্ধ, ভোট জালিয়াতি আর দমননীতি

নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয় এবং ভোট গণনা নিয়ে অনিয়মের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটির (SADC) পর্যবেক্ষক দলও জানায়, ‘বেশিরভাগ এলাকায় জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।’

পরিস্থিতি দ্রুতই ভয়াবহ রূপ নেয়। চার্চ সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এখনো পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা নির্ধারণে কাজ করছে। বহু লাশ গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা কয়েকশ নয়, সম্ভবত কয়েক হাজার। এটি সাম্প্রতিক আফ্রিকার ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।


সহিংসতার পরের নীরবতা

দমন-পীড়নের পর এখন তানজানিয়ায় এক ভয়াবহ নীরবতা নেমে এসেছে। বিরোধী আন্দোলন আপাতত স্তব্ধ। ইন্টারনেট পুনরায় চালু করা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। আফ্রিকার বহু দেশে যেমন নির্বাচনের পর কিছুটা ‘সমঝোতার সময়’ দেখা যায়, তেমনই একটি পরিস্থিতি এখন গড়ে উঠছে।

তবে জনঅভ্যুত্থান যে ভয় সৃষ্টি করেছে, তা সরকারের সিদ্ধান্তগুলোকে এখন আরও সতর্ক করে তুলেছে। টুন্ডু লিসুর মুক্তি নিয়ে যে গুঞ্জন ছিল, সেটিও এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।


 ক্ষমতার ভেতরের সংঘাত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

তানজানিয়ার রাজনীতি এখন অস্থির সময়ের মুখে। CCM আফ্রিকার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতাসীন মুক্তিযোদ্ধা দল হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী উন্নয়ন, কঠোর শাসন এবং দলীয় পুনর্গঠনের সুযোগ—এসবই তাকে টিকিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু সামিয়ার অবস্থান এখন নড়বড়ে। দলের ভেতরে, বিশেষত সেনাবাহিনীতে, অনেকেই তাকে বোঝা মনে করছেন। গুঞ্জন রয়েছে, খুব শিগগির তাকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। আন্দোলনকারীরা ইতিমধ্যেই তাকে ‘ইদি আমিন মামা’ নামে অভিহিত করছে।

নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করার স্বার্থে সামিয়া নিশ্চয়ই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চাইবেন। ২০৩০ সালের নির্বাচনের আগেই তার উত্তরসূরি নিয়ে CCM-এ অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু যাই হোক না কেন, সামিয়ার শাসন ইতিমধ্যেই শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে তানজানিয়ার ভাবমূর্তি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে।


#তানজানিয়া #দমন_পীড়ন #সামিয়া_সুলুহু #নির্বাচন২০২৫ #আফ্রিকা #গণঅভ্যুত্থান #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

ঢাকায় দিনের আলোয় গুলিতে নিহত একজন

তানজানিয়ায় দমন-পীড়ন: রক্তে রাঙানো এক নতুন বাস্তবতা

১২:৫৮:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

উদ্বোধনের আড়ালে ভয় আর অনিশ্চয়তা

৩ নভেম্বর ২০২৫—তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামিয়া সুলুহু হাসানের শপথ অনুষ্ঠান ছিল এক বৈপরীত্যপূর্ণ দৃশ্য। মাত্র কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার দাবি করলেও, অভিষেক অনুষ্ঠানে আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন খুব কমই ছিল। অনুষ্ঠানটি হঠাৎ করেই রাজধানী দোদোমার সামরিক প্যারেড গ্রাউন্ডে সরিয়ে আনা হয়, জনসাধারণকে উপস্থিত থাকতে নিষেধ করা হয়, আর আফ্রিকার মাত্র চারজন রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত ছিলেন।

এই পরিবর্তনগুলো আসলে শাসক দল চামা চা মাপিন্দুজির (CCM) ভয়ের প্রতিফলন। নির্বাচনের পর তানজানিয়া জুড়ে যে বিক্ষোভ দেখা দেয়, তা দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জনআন্দোলন হয়ে ওঠে। বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে, নেতাদের কারাগারে পাঠিয়ে এবং ভোটের ফলাফল জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল CCM। কিন্তু জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব।


 গণতন্ত্রের দাবিতে তরুণদের উত্থান

নেপাল ও মাদাগাস্কারের পর তানজানিয়ায় তরুণ প্রজন্মের এই গণঅভ্যুত্থান অনেককে অবাক করেছে। নির্বাচনের আগে আফ্রোব্যারোমিটারের জরিপ অনুযায়ী, CCM তখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ২০২৫ সালে প্রায় ৬ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল।

তবে আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি অর্থনীতি নয়, গণতন্ত্রের দাবি। ব্রিটিশ গবেষক ড্যান পাগেটের মতে, তানজানিয়ার বিরোধী আন্দোলন নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে ‘গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন’ হিসেবে। বিরোধী দল চাদেমার কারাবন্দি নেতা টুন্ডু লিসু নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার স্লোগান ছিল: ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়।’

এই বছরই নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিরোধী দলের বহু কর্মী নিখোঁজ হয়েছে বলে অভিযোগ। ২০২১ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির মৃত্যুর পর সামিয়া যখন ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে প্রেসিডেন্ট হন, তখন থেকেই তার শাসনকাঠামো আরও কঠোর হয়ে ওঠে।


 ইন্টারনেট বন্ধ, ভোট জালিয়াতি আর দমননীতি

নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয় এবং ভোট গণনা নিয়ে অনিয়মের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটির (SADC) পর্যবেক্ষক দলও জানায়, ‘বেশিরভাগ এলাকায় জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।’

পরিস্থিতি দ্রুতই ভয়াবহ রূপ নেয়। চার্চ সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এখনো পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা নির্ধারণে কাজ করছে। বহু লাশ গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা কয়েকশ নয়, সম্ভবত কয়েক হাজার। এটি সাম্প্রতিক আফ্রিকার ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।


সহিংসতার পরের নীরবতা

দমন-পীড়নের পর এখন তানজানিয়ায় এক ভয়াবহ নীরবতা নেমে এসেছে। বিরোধী আন্দোলন আপাতত স্তব্ধ। ইন্টারনেট পুনরায় চালু করা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। আফ্রিকার বহু দেশে যেমন নির্বাচনের পর কিছুটা ‘সমঝোতার সময়’ দেখা যায়, তেমনই একটি পরিস্থিতি এখন গড়ে উঠছে।

তবে জনঅভ্যুত্থান যে ভয় সৃষ্টি করেছে, তা সরকারের সিদ্ধান্তগুলোকে এখন আরও সতর্ক করে তুলেছে। টুন্ডু লিসুর মুক্তি নিয়ে যে গুঞ্জন ছিল, সেটিও এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।


 ক্ষমতার ভেতরের সংঘাত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

তানজানিয়ার রাজনীতি এখন অস্থির সময়ের মুখে। CCM আফ্রিকার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতাসীন মুক্তিযোদ্ধা দল হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী উন্নয়ন, কঠোর শাসন এবং দলীয় পুনর্গঠনের সুযোগ—এসবই তাকে টিকিয়ে রেখেছিল।

কিন্তু সামিয়ার অবস্থান এখন নড়বড়ে। দলের ভেতরে, বিশেষত সেনাবাহিনীতে, অনেকেই তাকে বোঝা মনে করছেন। গুঞ্জন রয়েছে, খুব শিগগির তাকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। আন্দোলনকারীরা ইতিমধ্যেই তাকে ‘ইদি আমিন মামা’ নামে অভিহিত করছে।

নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করার স্বার্থে সামিয়া নিশ্চয়ই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চাইবেন। ২০৩০ সালের নির্বাচনের আগেই তার উত্তরসূরি নিয়ে CCM-এ অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু যাই হোক না কেন, সামিয়ার শাসন ইতিমধ্যেই শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে তানজানিয়ার ভাবমূর্তি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে।


#তানজানিয়া #দমন_পীড়ন #সামিয়া_সুলুহু #নির্বাচন২০২৫ #আফ্রিকা #গণঅভ্যুত্থান #সারাক্ষণ_রিপোর্ট