০৫:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
আমাজনের বেলেং-এ শুরু হলো কপ৩০, যুক্তরাষ্ট্র নেই আলোচনার টেবিলে সপ্তাহের শুরুতেই শেয়ারবাজারে ধস: ডিএসই সূচক ৬৮ পয়েন্ট ও সিএসই ৩৫ পয়েন্ট কমেছে ২০২৫ সালের গিফট গাইডে এআই ও ওয়্যারেবলকে শীর্ষে তুলল এনগ্যাজেট তাইওয়ান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে চীনা কূটনীতিককে ডেকে পাঠাল টোকিও ব্রিটেনকে বিনিয়োগকারীদের বার্তা: একটু আশাবাদী হোন ভারতের অদ্ভুত স্থিতিশীলতা: অস্থির প্রতিবেশে শান্ত শক্তি  ধানমন্ডিতে মাইডাস ও ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ তেহরানে এক কোটি মানুষের দুই সপ্তাহ চলার মতো পানি আছে সাভারে ৪ কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ: টিয়ারশেল ও জলকামান নিক্ষেপে উত্তেজনা সহজ বিয়ের ঢেউ: বিলাস নয়, সাধারণতার সৌন্দর্যে নতুন প্রজন্মের ভালোবাসা

সমাধিক্ষেত্রের পদচিহ্নে ইতিহাস ও কল্পনার ছায়া

মৃতদের শহরের গল্পগুলো

আর্জেন্টাইন লেখিকা মারিয়ানা এনরিকেজ মৃত্যুকে শুধু এক ভয়ের ধারণা নয়, বরং এক নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেন। তার বই “Somebody Is Walking on Your Grave: My Cemetery Journeys” (বাংলা অনুবাদে অর্থ দাঁড়ায় — “কেউ তোমার কবরের ওপর হাঁটছে: আমার সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ”) এই দৃষ্টিভঙ্গিরই এক চিত্তাকর্ষক প্রকাশ। অনুবাদ করেছেন তার দীর্ঘদিনের সহযোগী মেগান ম্যাকডাওয়েল। ৩৩৬ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে হগার্থ প্রেস ও গ্রান্টা বুকস।

সমাধি দর্শনের তিন পথ

বিশ্বজুড়ে সমাধিক্ষেত্র দর্শনার্থীরা সাধারণত তিন দলে বিভক্ত —
১. যাঁরা প্রিয়জনের কবর দেখতে বা শ্রদ্ধা জানাতে যান,
২. যাঁরা তাদের প্রিয় শিল্পী বা নায়কের শেষ বিশ্রামস্থল দেখতে চান,
৩. আর একদল আছে যাদের বলা যায় “সমাধি রসিক”— তারা কবরস্থানের ইতিহাস, স্থাপত্য, শিল্প বা ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট।

এনরিকেজ নিজেকে তৃতীয় দলের মানুষ বলে গর্ব করেন। গথিক ও ভৌতিক গল্পের লেখিকা হিসেবে মৃত্যুকে তিনি বহুবার কল্পনায় রূপ দিয়েছেন। তার গল্পসংগ্রহ “The Dangers of Smoking in Bed” আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য ২০২১ সালে শর্টলিস্ট হয়েছিল। এবার তিনি কল্পনার জগৎ ছেড়ে বাস্তব সমাধিক্ষেত্রের পথে বেরিয়েছেন।

জেনোয়া থেকে যাত্রার সূচনা

বইটির শুরুতে এনরিকেজ ফিরে গেছেন ১৯৯৭ সালের ইতালির জেনোয়ায়, স্টাগলিয়েনো মনুমেন্টাল সেমেট্রিতে। সেখানেই এক স্থানীয় যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার— আর সেই রোমাঞ্চ ও আবেগের মধ্যেই তিনি প্রথম “সমাধিক্ষেত্রের প্রেমে পড়েন।” বিশাল মূর্তিশিল্প, অলঙ্কৃত সমাধিফলক ও কলোনেডের মাঝখানে যেন মৃত্যু তার কাছে হয়ে ওঠে এক জীবন্ত শিল্পরূপ।

এরপরের অধ্যায়গুলোতে তিনি ঘুরেছেন কিউবা, চিলে, চেক প্রজাতন্ত্র, লন্ডনের হাইগেট সেমেট্রি এবং অস্ট্রেলিয়ার রটনেস্ট দ্বীপের অচিহ্নিত আদিবাসী সমাধিস্থল— যেখানে, তার ভাষায়, “সম্ভবত কারও ছুটি নষ্ট না করতে” কবরগুলো চিহ্নহীন রাখা হয়েছে।

ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মৃত্যুর পাঠ

এনরিকেজের আগ্রহ কেবল মৃত্যুর প্রতি নয়, বরং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বোঝার প্রতি।
নিউ অরলিন্সে বন্যার ঝুঁকির কারণে মৃতদেহগুলো মাটির ওপরে সমাধিস্থ করা হয়, আর শহরটিতে আছে ৪২টি ঐতিহাসিক কবরস্থান— যেগুলোর সারিবদ্ধ সমাধিগুলো যেন “মৃতদের সুশৃঙ্খল নগরী”। তাই বিস্ময়কর নয় যে, ভ্যাম্পায়ার ও ভূতের কাহিনির এত জন্ম হয়েছে এখান থেকেই।

প্যারিসের ক্যাটাকম্বে হাড়গোড় সাজানো হয়েছে শিল্পকর্মের মতো। এমনকি ১৮৯৭ সালে কিছু ধনী মানুষ গোপনে সেখানে “মৃত্যুর সঙ্গীতানুষ্ঠান” আয়োজন করেছিলেন— শুধুমাত্র শোকগাথা শোনার জন্য।

রাজনীতি, দেহ ও দখলের গল্প

এনরিকেজের ভ্রমণ কেবল বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সমাধিতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ঘুরেছেন কার্ল মার্কস, ফ্রান্‌ৎস কাফকার মতো মানুষের কবরেও, কিন্তু সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অংশগুলো হলো সেই কবরগুলো যেগুলো রাজনৈতিক বিরোধের প্রতীক।

আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিদ্রোহীরা জুয়ান পেরনের স্ত্রী ইভা পেরনের মৃতদেহ চুরি করে বিকৃত করেছিল। পরে দেহটি ইতালিতে গোপনে রাখা হয়েছিল এক দশকেরও বেশি সময়। অবশেষে তাকে বুয়েনস আয়ার্সে সমাধিস্থ করা হয়— মাটি থেকে আট মিটার নিচে, মোটা কংক্রিটের নিচে। এনরিকেজ মন্তব্য করেছেন, “ওখানেই ইভার জন্য একটি সমাধি তৈরি আছে, কিন্তু মনে হয় তার দেহ সেখানে স্থানান্তর করা সহজ হবে না।”

সমাধিক্ষেত্রের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি

একসময় ইউরোপে কবরস্থান থাকত শহরের দেয়ালের ভেতরে, গির্জার পাশে, যাতে পবিত্রতা ও সুরক্ষা বজায় থাকে। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে মৃতদেহকে রোগের উৎস হিসেবে দেখা শুরু হলে, কবরস্থানগুলোকে শহর থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। মানুষ তখন মৃত্যুর সান্নিধ্যকে ঘৃণা করতে শেখে।

মৃত্যুর সৌন্দর্যে মুগ্ধতা

তবে এনরিকেজের কাছে মৃত্যু আতঙ্ক নয়, আনন্দের উৎস। তার লেখায় ভৌতিকতা ঝলমল করে এক ধরনের উচ্ছ্বাসে। তিনি বলেন, মেক্সিকোর ‘ডে অব দ্য ডেড’ উৎসব (১ ও ২ নভেম্বর), যেখানে মানুষ কবর সাজায় ও মৃতদের স্মরণ করে, তা “অসহনীয়ভাবে আনন্দময়”। তার স্বামী বলেন, এই অনুষ্ঠানগুলো যেন এনরিকেজের কাছে “হারানো স্বর্গ” পুনরুদ্ধারের উপায়।

মৃত্যু, শিল্প ও জীবনের মিশ্রণ

বইটির শেষে পাঠকের মনে জন্ম নেয় নতুন এক উপলব্ধি— প্রতিটি কবরের নিচে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অজানা গল্প, ইতিহাস, প্রেম, এবং মানবিক স্মৃতি। এনরিকেজের যাত্রা প্রমাণ করে, সমাধিক্ষেত্র কেবল শোকের স্থান নয়, বরং মানব সভ্যতার এক নীরব আয়না, যেখানে জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখা মুছে যায় সৌন্দর্যের ছোঁয়ায়।

#সমাধিক্ষেত্র #মারিয়ানা_এনরিকেজ #সাহিত্যসমালোচনা #মৃত্যুসংস্কৃতি #বইপর্যালোচনা

জনপ্রিয় সংবাদ

আমাজনের বেলেং-এ শুরু হলো কপ৩০, যুক্তরাষ্ট্র নেই আলোচনার টেবিলে

সমাধিক্ষেত্রের পদচিহ্নে ইতিহাস ও কল্পনার ছায়া

০৩:২০:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

মৃতদের শহরের গল্পগুলো

আর্জেন্টাইন লেখিকা মারিয়ানা এনরিকেজ মৃত্যুকে শুধু এক ভয়ের ধারণা নয়, বরং এক নান্দনিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেন। তার বই “Somebody Is Walking on Your Grave: My Cemetery Journeys” (বাংলা অনুবাদে অর্থ দাঁড়ায় — “কেউ তোমার কবরের ওপর হাঁটছে: আমার সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ”) এই দৃষ্টিভঙ্গিরই এক চিত্তাকর্ষক প্রকাশ। অনুবাদ করেছেন তার দীর্ঘদিনের সহযোগী মেগান ম্যাকডাওয়েল। ৩৩৬ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে হগার্থ প্রেস ও গ্রান্টা বুকস।

সমাধি দর্শনের তিন পথ

বিশ্বজুড়ে সমাধিক্ষেত্র দর্শনার্থীরা সাধারণত তিন দলে বিভক্ত —
১. যাঁরা প্রিয়জনের কবর দেখতে বা শ্রদ্ধা জানাতে যান,
২. যাঁরা তাদের প্রিয় শিল্পী বা নায়কের শেষ বিশ্রামস্থল দেখতে চান,
৩. আর একদল আছে যাদের বলা যায় “সমাধি রসিক”— তারা কবরস্থানের ইতিহাস, স্থাপত্য, শিল্প বা ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট।

এনরিকেজ নিজেকে তৃতীয় দলের মানুষ বলে গর্ব করেন। গথিক ও ভৌতিক গল্পের লেখিকা হিসেবে মৃত্যুকে তিনি বহুবার কল্পনায় রূপ দিয়েছেন। তার গল্পসংগ্রহ “The Dangers of Smoking in Bed” আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য ২০২১ সালে শর্টলিস্ট হয়েছিল। এবার তিনি কল্পনার জগৎ ছেড়ে বাস্তব সমাধিক্ষেত্রের পথে বেরিয়েছেন।

জেনোয়া থেকে যাত্রার সূচনা

বইটির শুরুতে এনরিকেজ ফিরে গেছেন ১৯৯৭ সালের ইতালির জেনোয়ায়, স্টাগলিয়েনো মনুমেন্টাল সেমেট্রিতে। সেখানেই এক স্থানীয় যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার— আর সেই রোমাঞ্চ ও আবেগের মধ্যেই তিনি প্রথম “সমাধিক্ষেত্রের প্রেমে পড়েন।” বিশাল মূর্তিশিল্প, অলঙ্কৃত সমাধিফলক ও কলোনেডের মাঝখানে যেন মৃত্যু তার কাছে হয়ে ওঠে এক জীবন্ত শিল্পরূপ।

এরপরের অধ্যায়গুলোতে তিনি ঘুরেছেন কিউবা, চিলে, চেক প্রজাতন্ত্র, লন্ডনের হাইগেট সেমেট্রি এবং অস্ট্রেলিয়ার রটনেস্ট দ্বীপের অচিহ্নিত আদিবাসী সমাধিস্থল— যেখানে, তার ভাষায়, “সম্ভবত কারও ছুটি নষ্ট না করতে” কবরগুলো চিহ্নহীন রাখা হয়েছে।

ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মৃত্যুর পাঠ

এনরিকেজের আগ্রহ কেবল মৃত্যুর প্রতি নয়, বরং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বোঝার প্রতি।
নিউ অরলিন্সে বন্যার ঝুঁকির কারণে মৃতদেহগুলো মাটির ওপরে সমাধিস্থ করা হয়, আর শহরটিতে আছে ৪২টি ঐতিহাসিক কবরস্থান— যেগুলোর সারিবদ্ধ সমাধিগুলো যেন “মৃতদের সুশৃঙ্খল নগরী”। তাই বিস্ময়কর নয় যে, ভ্যাম্পায়ার ও ভূতের কাহিনির এত জন্ম হয়েছে এখান থেকেই।

প্যারিসের ক্যাটাকম্বে হাড়গোড় সাজানো হয়েছে শিল্পকর্মের মতো। এমনকি ১৮৯৭ সালে কিছু ধনী মানুষ গোপনে সেখানে “মৃত্যুর সঙ্গীতানুষ্ঠান” আয়োজন করেছিলেন— শুধুমাত্র শোকগাথা শোনার জন্য।

রাজনীতি, দেহ ও দখলের গল্প

এনরিকেজের ভ্রমণ কেবল বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সমাধিতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ঘুরেছেন কার্ল মার্কস, ফ্রান্‌ৎস কাফকার মতো মানুষের কবরেও, কিন্তু সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অংশগুলো হলো সেই কবরগুলো যেগুলো রাজনৈতিক বিরোধের প্রতীক।

আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিদ্রোহীরা জুয়ান পেরনের স্ত্রী ইভা পেরনের মৃতদেহ চুরি করে বিকৃত করেছিল। পরে দেহটি ইতালিতে গোপনে রাখা হয়েছিল এক দশকেরও বেশি সময়। অবশেষে তাকে বুয়েনস আয়ার্সে সমাধিস্থ করা হয়— মাটি থেকে আট মিটার নিচে, মোটা কংক্রিটের নিচে। এনরিকেজ মন্তব্য করেছেন, “ওখানেই ইভার জন্য একটি সমাধি তৈরি আছে, কিন্তু মনে হয় তার দেহ সেখানে স্থানান্তর করা সহজ হবে না।”

সমাধিক্ষেত্রের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি

একসময় ইউরোপে কবরস্থান থাকত শহরের দেয়ালের ভেতরে, গির্জার পাশে, যাতে পবিত্রতা ও সুরক্ষা বজায় থাকে। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে মৃতদেহকে রোগের উৎস হিসেবে দেখা শুরু হলে, কবরস্থানগুলোকে শহর থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। মানুষ তখন মৃত্যুর সান্নিধ্যকে ঘৃণা করতে শেখে।

মৃত্যুর সৌন্দর্যে মুগ্ধতা

তবে এনরিকেজের কাছে মৃত্যু আতঙ্ক নয়, আনন্দের উৎস। তার লেখায় ভৌতিকতা ঝলমল করে এক ধরনের উচ্ছ্বাসে। তিনি বলেন, মেক্সিকোর ‘ডে অব দ্য ডেড’ উৎসব (১ ও ২ নভেম্বর), যেখানে মানুষ কবর সাজায় ও মৃতদের স্মরণ করে, তা “অসহনীয়ভাবে আনন্দময়”। তার স্বামী বলেন, এই অনুষ্ঠানগুলো যেন এনরিকেজের কাছে “হারানো স্বর্গ” পুনরুদ্ধারের উপায়।

মৃত্যু, শিল্প ও জীবনের মিশ্রণ

বইটির শেষে পাঠকের মনে জন্ম নেয় নতুন এক উপলব্ধি— প্রতিটি কবরের নিচে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অজানা গল্প, ইতিহাস, প্রেম, এবং মানবিক স্মৃতি। এনরিকেজের যাত্রা প্রমাণ করে, সমাধিক্ষেত্র কেবল শোকের স্থান নয়, বরং মানব সভ্যতার এক নীরব আয়না, যেখানে জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখা মুছে যায় সৌন্দর্যের ছোঁয়ায়।

#সমাধিক্ষেত্র #মারিয়ানা_এনরিকেজ #সাহিত্যসমালোচনা #মৃত্যুসংস্কৃতি #বইপর্যালোচনা