০৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

বিকাশমান মস্তিষ্কের মানচিত্র উন্মোচন: বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার

মানব মস্তিষ্ক কীভাবে ভ্রূণাবস্থা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছায়— সেই জটিল প্রক্রিয়ার একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরিতে এক বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই গবেষণা অটিজম, স্কিজোফ্রেনিয়া, ও এডিএইচডি-র মতো স্নায়ুজনিত ব্যাধি বোঝার নতুন দিক খুলে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।


মস্তিষ্কের বিকাশ বোঝার নতুন দিগন্ত

ওয়াশিংটন, ৬ নভেম্বর — মানব ও প্রাণীর মস্তিষ্কের বিকাশ প্রক্রিয়া উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা অর্জন করেছেন এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো মস্তিষ্কজনিত রোগের চিকিৎসা ও গবেষণায় নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করা।

গবেষক দল জানিয়েছে, তারা বিকাশমান মানব মস্তিষ্ক এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কের প্রথম খসড়া ‘অ্যাটলাস’ সম্পন্ন করেছেন।


গবেষণার পরিধি ও লক্ষ্য

এই প্রকল্পে মানুষ ও ইঁদুরের মস্তিষ্ককোষের বিকাশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, কিছু বানরের মস্তিষ্ক নিয়েও গবেষণা চালানো হয়। বিজ্ঞানীরা কোষগুলোর জন্ম, বিকাশ, পার্থক্য ও পরিপক্বতার ধাপগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। একইসঙ্গে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোষে কোন জিন সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হচ্ছে তাও নির্ণয় করা হয়েছে।

ফলাফলে দেখা গেছে, কিছু জিন মস্তিষ্কের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া, মানুষ ও প্রাণীর মস্তিষ্কে কিছু মিল থাকলেও মানব মস্তিষ্কের কিছু দিক সম্পূর্ণ অনন্য। পূর্বে অজানা বেশ কিছু কোষের ধরনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।


‘ব্রেইন অ্যাটলাস’ প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

এই গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর অধীনে পরিচালিত ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ সেল অ্যাটলাস নেটওয়ার্ক (BICAN)-এর অংশ। এটি মানব মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরির জন্য একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রকল্প।

অ্যালেন ইনস্টিটিউটের মস্তিষ্কবিজ্ঞান পরিচালক ও গবেষণার অন্যতম নেতা হংকুই জেং বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কে হাজারো প্রকার কোষ আছে, যেগুলোর বৈশিষ্ট্য ও কাজ ভিন্ন। এই কোষগুলোর সম্মিলিত কাজেই তৈরি হয় আমাদের আচরণ, আবেগ ও চিন্তাশক্তি।’

গবেষকরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে পাঁচ হাজারেরও বেশি কোষের ধরন শনাক্ত করেছেন, আর মানুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


বিকাশমান মস্তিষ্কের জটিলতা উন্মোচন

ইউসিএলএর স্নায়ুবিজ্ঞানী অপর্ণা ভাদুরি বলেন, ‘বিকাশমান মস্তিষ্ক অত্যন্ত রহস্যময় একটি কাঠামো। এখানে অসংখ্য কোষের ধরন ও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আগে আমরা কেবল সামগ্রিক পরিবর্তন বুঝতাম, এখন এই অ্যাটলাসের মাধ্যমে আমরা সূক্ষ্মভাবে জানতে পারছি কোন অংশে কীভাবে কোষগুলো বিকশিত হয়।’


গবেষণার ব্যবহারিক প্রয়োগ

জেং-এর মতে, মানুষ ও প্রাণীর মস্তিষ্ক বিকাশ তুলনা করলে মানব মস্তিষ্কের বিশেষত্ব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এই তুলনা থেকে মানব বুদ্ধিমত্তার গঠন ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কেও নতুন ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি, এই জ্ঞান ব্যবহার করে অটিজম, স্কিজোফ্রেনিয়া, এবং এডিএইচডি-র মতো স্নায়ুবিক রোগের চিকিৎসায় নতুন দিক উন্মোচিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে জিন-ভিত্তিক ও কোষ-নির্ভর আরও নির্ভুল চিকিৎসা উদ্ভাবন সম্ভব হবে।


নিওকর্টেক্স ও হাইপোথ্যালামাসে নতুন সন্ধান

গবেষণায় তৈরি অ্যাটলাসে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিওকর্টেক্স— যেখানে ঘটে উচ্চতর মানসিক কার্যক্রম, এবং হাইপোথ্যালামাস, যা শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, ঘুম, ক্ষুধা, মেজাজ ও যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের কিছু মস্তিষ্কের টিউমার কোষ ভ্রূণীয় ‘প্রোজেনিটর সেল’-এর মতো আচরণ করে, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলের কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে কিছু টিউমার হয়তো বিকাশজনিত প্রক্রিয়া ‘দখল করে নেয়’, যার ফলে ক্যানসার সৃষ্টি হয়।


মানব মস্তিষ্কের বিশেষ বৈশিষ্ট্য

মানব মস্তিষ্কের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো কোষের পার্থক্যকরণ বা বিভাজনের দীর্ঘ সময়কাল। ভ্রূণ থেকে কৈশোর পর্যন্ত মানব মস্তিষ্কের বিকাশ ধীরগতি ও দীর্ঘায়িত হয়, যা অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি সময় নেয়।

নিওকর্টেক্স ও স্ট্রায়াটাম অঞ্চলে (যা চলাচল ও জটিল কাজ নিয়ন্ত্রণ করে) নতুন কিছু কোষের ধরনও শনাক্ত করা হয়েছে।


ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও গবেষণার অগ্রগতি

ভাদুরি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য কেবল বিকাশমান মস্তিষ্কের অংশ শনাক্ত করা নয়, বরং বোঝা— কোন ধাপে মস্তিষ্কজনিত ব্যাধি বা মানসিক রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা মস্তিষ্ক ক্যানসার নিয়েও গবেষণা করছি, কারণ এই রোগে বিকাশজনিত প্রক্রিয়াগুলো আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল কাজ, তবে এই গবেষণা তার পথে এক বড় পদক্ষেপ।’


#বিজ্ঞান
#মস্তিষ্ক_গবেষণা
#স্বাস্থ্য
#অটিজম
#স্কিজোফ্রেনিয়া
#ব্রেইন_অ্যাটলাস
#বিকাশমান_মস্তিষ্ক

জনপ্রিয় সংবাদ

বিকাশমান মস্তিষ্কের মানচিত্র উন্মোচন: বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার

০১:৪৯:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

মানব মস্তিষ্ক কীভাবে ভ্রূণাবস্থা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছায়— সেই জটিল প্রক্রিয়ার একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরিতে এক বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই গবেষণা অটিজম, স্কিজোফ্রেনিয়া, ও এডিএইচডি-র মতো স্নায়ুজনিত ব্যাধি বোঝার নতুন দিক খুলে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।


মস্তিষ্কের বিকাশ বোঝার নতুন দিগন্ত

ওয়াশিংটন, ৬ নভেম্বর — মানব ও প্রাণীর মস্তিষ্কের বিকাশ প্রক্রিয়া উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা অর্জন করেছেন এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো মস্তিষ্কজনিত রোগের চিকিৎসা ও গবেষণায় নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করা।

গবেষক দল জানিয়েছে, তারা বিকাশমান মানব মস্তিষ্ক এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কের প্রথম খসড়া ‘অ্যাটলাস’ সম্পন্ন করেছেন।


গবেষণার পরিধি ও লক্ষ্য

এই প্রকল্পে মানুষ ও ইঁদুরের মস্তিষ্ককোষের বিকাশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, কিছু বানরের মস্তিষ্ক নিয়েও গবেষণা চালানো হয়। বিজ্ঞানীরা কোষগুলোর জন্ম, বিকাশ, পার্থক্য ও পরিপক্বতার ধাপগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। একইসঙ্গে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোষে কোন জিন সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় হচ্ছে তাও নির্ণয় করা হয়েছে।

ফলাফলে দেখা গেছে, কিছু জিন মস্তিষ্কের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া, মানুষ ও প্রাণীর মস্তিষ্কে কিছু মিল থাকলেও মানব মস্তিষ্কের কিছু দিক সম্পূর্ণ অনন্য। পূর্বে অজানা বেশ কিছু কোষের ধরনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।


‘ব্রেইন অ্যাটলাস’ প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব

এই গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর অধীনে পরিচালিত ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ সেল অ্যাটলাস নেটওয়ার্ক (BICAN)-এর অংশ। এটি মানব মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরির জন্য একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রকল্প।

অ্যালেন ইনস্টিটিউটের মস্তিষ্কবিজ্ঞান পরিচালক ও গবেষণার অন্যতম নেতা হংকুই জেং বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্কে হাজারো প্রকার কোষ আছে, যেগুলোর বৈশিষ্ট্য ও কাজ ভিন্ন। এই কোষগুলোর সম্মিলিত কাজেই তৈরি হয় আমাদের আচরণ, আবেগ ও চিন্তাশক্তি।’

গবেষকরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে পাঁচ হাজারেরও বেশি কোষের ধরন শনাক্ত করেছেন, আর মানুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


বিকাশমান মস্তিষ্কের জটিলতা উন্মোচন

ইউসিএলএর স্নায়ুবিজ্ঞানী অপর্ণা ভাদুরি বলেন, ‘বিকাশমান মস্তিষ্ক অত্যন্ত রহস্যময় একটি কাঠামো। এখানে অসংখ্য কোষের ধরন ও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। আগে আমরা কেবল সামগ্রিক পরিবর্তন বুঝতাম, এখন এই অ্যাটলাসের মাধ্যমে আমরা সূক্ষ্মভাবে জানতে পারছি কোন অংশে কীভাবে কোষগুলো বিকশিত হয়।’


গবেষণার ব্যবহারিক প্রয়োগ

জেং-এর মতে, মানুষ ও প্রাণীর মস্তিষ্ক বিকাশ তুলনা করলে মানব মস্তিষ্কের বিশেষত্ব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এই তুলনা থেকে মানব বুদ্ধিমত্তার গঠন ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কেও নতুন ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি, এই জ্ঞান ব্যবহার করে অটিজম, স্কিজোফ্রেনিয়া, এবং এডিএইচডি-র মতো স্নায়ুবিক রোগের চিকিৎসায় নতুন দিক উন্মোচিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে জিন-ভিত্তিক ও কোষ-নির্ভর আরও নির্ভুল চিকিৎসা উদ্ভাবন সম্ভব হবে।


নিওকর্টেক্স ও হাইপোথ্যালামাসে নতুন সন্ধান

গবেষণায় তৈরি অ্যাটলাসে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিওকর্টেক্স— যেখানে ঘটে উচ্চতর মানসিক কার্যক্রম, এবং হাইপোথ্যালামাস, যা শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, ঘুম, ক্ষুধা, মেজাজ ও যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের কিছু মস্তিষ্কের টিউমার কোষ ভ্রূণীয় ‘প্রোজেনিটর সেল’-এর মতো আচরণ করে, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলের কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে কিছু টিউমার হয়তো বিকাশজনিত প্রক্রিয়া ‘দখল করে নেয়’, যার ফলে ক্যানসার সৃষ্টি হয়।


মানব মস্তিষ্কের বিশেষ বৈশিষ্ট্য

মানব মস্তিষ্কের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো কোষের পার্থক্যকরণ বা বিভাজনের দীর্ঘ সময়কাল। ভ্রূণ থেকে কৈশোর পর্যন্ত মানব মস্তিষ্কের বিকাশ ধীরগতি ও দীর্ঘায়িত হয়, যা অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি সময় নেয়।

নিওকর্টেক্স ও স্ট্রায়াটাম অঞ্চলে (যা চলাচল ও জটিল কাজ নিয়ন্ত্রণ করে) নতুন কিছু কোষের ধরনও শনাক্ত করা হয়েছে।


ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও গবেষণার অগ্রগতি

ভাদুরি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য কেবল বিকাশমান মস্তিষ্কের অংশ শনাক্ত করা নয়, বরং বোঝা— কোন ধাপে মস্তিষ্কজনিত ব্যাধি বা মানসিক রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা মস্তিষ্ক ক্যানসার নিয়েও গবেষণা করছি, কারণ এই রোগে বিকাশজনিত প্রক্রিয়াগুলো আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল কাজ, তবে এই গবেষণা তার পথে এক বড় পদক্ষেপ।’


#বিজ্ঞান
#মস্তিষ্ক_গবেষণা
#স্বাস্থ্য
#অটিজম
#স্কিজোফ্রেনিয়া
#ব্রেইন_অ্যাটলাস
#বিকাশমান_মস্তিষ্ক