এক দশকের প্রস্তুতি
চীন এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বায়োফার্মাসিউটিক্যাল শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই উত্থান শুরু হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে, ২০১৫ সালে ওষুধ অনুমোদন নীতিমালার সংস্কার ও “মেইড ইন চায়না ২০২৫” কর্মসূচিতে বায়োটেককে কৌশলগত খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে।
হংকংয়ে শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন
চীনা কোম্পানিগুলোর নতুন ওষুধ কেনাবেচায় হংকংয়ে তালিকাভুক্ত বায়োটেক শেয়ারগুলো চলতি বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ তালিকা নিয়ম অনুযায়ী ডজনখানেক বায়োটেক প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন ডলার তহবিল তুলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই উত্থান চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় “ডিপসিক মুহূর্ত”-এর মতো, তবে আরও উপযুক্ত তুলনা হলো বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) শিল্পের সঙ্গে।
ইভি শিল্পের ছায়ায় নতুন উত্থান
শেনঝেনভিত্তিক সিগনেট থেরাপিউটিকসের প্রধান ঝ্যাং হাইশেং বলেন, “চীনের বায়োটেক শিল্প অনেকটা ইভি শিল্পের মতো। একবার সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে পারলে, আমরা একই মানের পণ্য তৈরি করতে পারি।” টেসলার মতো পশ্চিমা কোম্পানির জন্য যেভাবে চীন ইভি সরবরাহ চেইন তৈরি করেছিল, তেমনি এখন তারা জেনেরিক ওষুধ তৈরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার ও বিরল রোগের ওষুধ উদ্ভাবন করছে।

দ্রুত উত্থান ও তীব্র প্রতিযোগিতা
ইভি শিল্পের মতোই, দ্রুত প্রবৃদ্ধি এখন তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। এতে ভোক্তারা লাভবান হলেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে অনেক কোম্পানির জন্য। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে, কারণ উভয় দেশই এখন বায়োটেক খাতকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখছে।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ
জিয়াংসু হেংরুই ফার্মাসিউটিক্যালস এখন জেনেরিকের পরিবর্তে উদ্ভাবনী ওষুধের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে গবেষণায় ব্যয় করেছে ৪৮ বিলিয়ন ইউয়ান (৬.৭ বিলিয়ন ডলার)। এ বছরের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১২টি ওষুধের একচেটিয়া উন্নয়ন অধিকার যুক্তরাজ্যের জিএসকে-কে বিক্রি করে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম পেয়েছে।
গবেষণায় চীনের অবস্থান
২০২৩ সালে চীনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রায় ৭০ শতাংশই উদ্ভাবনী ওষুধ নিয়ে। সিগনেটের ঝ্যাং বলেন, “দেশীয় বায়োটেক ইকোসিস্টেম এখন পরিপূর্ণ। ফলে নতুন কোম্পানিগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে।” ঝ্যাং নিজেও হার্ভার্ডে গবেষণা শেষে ২০২০ সালে চীনে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। একটি গবেষণা অনুযায়ী, চীনের ৪৩ জন বায়োটেক প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে ৪১ জনই পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় বা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে প্রশিক্ষিত।
আন্তর্জাতিক সাফল্যের পথ
সিগনেটের মূল ওষুধটি যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ থেকে দ্রুত অনুমোদন পেয়েছে এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ধাপে রয়েছে। এটি সফল হলে বিশ্বের বৃহত্তম ওষুধ বাজার—যুক্তরাষ্ট্রে—প্রবেশের সুযোগ পাবে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪৫ শতাংশ উদ্ভাবনী ওষুধের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে।
প্রতিযোগিতার প্রভাব ও মূল্য হ্রাস
জ্যাকোবিও ফার্মার প্রধান ওয়াং ইনশিয়াং বলেন, “আগে উদ্ভাবনী ওষুধ বাজারে ১০-১৫ বছর একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখত। এখন তা মাত্র এক-দুই বছরেই সীমিত।” ফলে প্রতিযোগিতা বাড়লেও দাম কমছে এবং রোগীরা আগেই ওষুধ পাচ্ছেন। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চীনে ক্লিনিক্যাল গবেষণার গড় খরচ বহুজাতিক কোম্পানির তুলনায় মাত্র ৩০-৫০ শতাংশ ছিল।
সাশ্রয়ী ওষুধের উদাহরণ
চীনের আসসেনটেজ ফার্মা তৈরি করেছে ওলভেরেমবাটিনিব নামের লিউকেমিয়া ওষুধ, যার দাম যুক্তরাষ্ট্রের সমমানের ওষুধের এক-তৃতীয়াংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আউট-লাইসেন্সিং: নতুন তহবিলের পথ
অর্থনৈতিক চাপে থাকা চীনা স্টার্টআপগুলো এখন বিদেশি কোম্পানিকে ওষুধ উন্নয়নের অধিকার বিক্রি করছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রেকর্ড ৪৮টি সীমান্তপারের চুক্তি হয়েছে, যার প্রাথমিক অর্থমূল্য ছিল ২.৬ বিলিয়ন ডলার। উদাহরণস্বরূপ, এ বছর ফাইজার ৩এসবায়ো নামের চীনা কোম্পানিকে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ক্যান্সারের ওষুধের অধিকার নিয়েছে।
রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা
তবে সবকিছু এতটা সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বায়োটেক খাতকে প্রভাবিত করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্র্যান্ডেড ওষুধ আমদানিতে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যদি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা না করে। অন্যদিকে, “বায়োসিকিউর অ্যাক্ট” আইনে চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারি সহযোগিতা সীমিত করার প্রস্তাব রয়েছে। এতে চীনের জন্য নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
সিগনেটের ঝ্যাং বলেন, “আমাদের জন্য এটি ডটকম বুদবুদের মতো সময়। যারা টিকে থাকবে, তারাই ভবিষ্যতে শিল্পের নেতা হবে।” তার মতে, “যদি পণ্য ভালো হয়, বাজারে পৌঁছানোর পথ সবসময় খোলা থাকে। বরং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোরতা প্রমাণ করে আমরা ভালোই এগোচ্ছি — না হলে তারা এত গুরুত্ব দিত না।”
#China #Biotech #Pharmaceutical #Innovation #Trade #EVIndustry #USChinaTensions #SarakhanReport
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















