ঐতিহাসিক সফরের সূচনা
থাইল্যান্ডের রাজা মাহা ভাজিরালংকর্ন বৃহস্পতিবার চীনে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন—যা হবে ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর কোনো থাই রাজার প্রথম সফর। এই সফর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ৫০ বছর পূর্তির অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই ভ্রমণ কেবল প্রতীকী নয়; এটি থাইল্যান্ড ও চীনের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
রাজা ভাজিরালংকর্ন ও রানি সুতিদার এই সফর মূলত ২০২২ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এপেক সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর পরিকল্পিত হয়। শি এরপর থেকে তিনজন থাই প্রধানমন্ত্রীকেও এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় শি থাই প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—“রাজার সফরের প্রোটোকল নিয়ে কোনো বিশেষ অনুরোধ আছে কি না।”
সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান
রাজদম্পতি সফরে চীনের সংস্কৃতি ও আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ সম্পর্কে জানবেন। তাঁদের কর্মসূচিতে রয়েছে বেইজিংয়ের লিংগুয়াং বৌদ্ধ মন্দির, বেইজিং অ্যারোস্পেস সিটি এবং হিউম্যানয়েড রোবোটিক্স ইনোভেশন সেন্টার পরিদর্শন।
সম্পর্কের নতুন মাত্রা
থমাসাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক পিনিতভান পারিবাত্র বলেন, “১৯৭৫ সালে থাই-চীন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পরেও থাই রাজা কখনো চীন সফরে যাননি। এই সফর সেই শূন্যতা পূরণ করবে এবং সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাইল্যান্ডের সম্পর্কের সমতুল্য পর্যায়ে নিয়ে যাবে।”
রাজা ভাজিরালংকর্নের বোন প্রিন্সেস সিরিনধর্ন দীর্ঘদিন ধরেই চীনের অনুরাগী; ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট শি তাঁকে চীনের ‘ফ্রেন্ডশিপ মেডেল’ প্রদান করেন। রাজা নিজেও ১৯৮৭ সালে যুবরাজ হিসেবে তাঁর পিতা রাজা ভূমিবলের প্রতিনিধি হয়ে চীন সফর করেছিলেন।
অতীতের রাজকীয় কূটনীতি
থাইল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় ১৯৬০ সালে, যখন রাজা ভূমিবল ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেন। তখনকার সময়ে তিনি ও রানি সিরিকিত বিশ্বমঞ্চে থাইল্যান্ডকে পশ্চিমা অ্যান্টি-কমিউনিস্ট ব্লকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তুলে ধরেন। ১৯৬০ সালে তাঁরা ১৭টি দেশ সফর করেছিলেন।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভাজিরালংকর্নের এই সফরটি তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের সাত মাস পর ঘটছে—যখন তিনি ভুটান সফর করেছিলেন। চীন এখন থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারী। চীনের অর্থায়নে থাইল্যান্ডে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন এবং উচ্চগতির রেল প্রকল্প চলছে।
চীনা পর্যটকরা থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও সম্প্রতি এক চীনা অভিনেতা অপহরণের ঘটনার পর তাঁদের আগমন হ্রাস পেয়েছে।
ঠান্ডা যুদ্ধ থেকে বন্ধুত্বের সেতু
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় (১৯৫০-১৯৭২) চীন থাইল্যান্ডকে শত্রু মনে করত, কারণ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। লেখক সিরিন ফাথানথাই তাঁর স্মৃতিকথা ‘দ্য ড্রাগন’স পার্ল’-এ উল্লেখ করেছেন, “সেই সময় থাই সরকার চীনা বংশোদ্ভূতদের সন্দেহের চোখে দেখত এবং অনেকে কালো তালিকাভুক্ত হতেন।”
তিনি জানান, ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইয়ের আহ্বানে তিনি ‘পিং-পং কূটনীতি’র অংশ হিসেবে থাইল্যান্ড ও চীনের মধ্যে গোপন আলোচনার ব্যবস্থা করেন, যা পরবর্তীতে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভিত্তি গড়ে দেয়।
সম্পর্কের বিকাশ ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরোমিয়া বলেন, “শুরুর দিকে সম্পর্ক কঠিন ছিল, তবে উভয় পক্ষই ধৈর্য ধরে এগিয়েছে। থাইল্যান্ড তাইওয়ানের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক না রেখে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে, আর বেইজিং থাইল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন বন্ধ করেছে।”
তিনি যোগ করেন, “আমাদের এক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে—এই ঐতিহ্যকে বুঝতে পারলেই বর্তমান রাজা ভাজিরালংকর্নের সফরের তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে।”
তবে কাসিত আরও বলেন, আজকের প্রেক্ষাপটে থাইল্যান্ডের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কিছুটা কমেছে। “থাইল্যান্ড এখন আর চীনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সারির রাষ্ট্র নয়; সেই ভূমিকা এখন নিয়েছে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন।”
#থাইল্যান্ড #চীন #রাজকীয়_সফর #কূটনীতি #ভাজিরালংকর্ন #শি_জিনপিং #আন্তর্জাতিক_সম্পর্ক
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















