সরু গলির বাজারে হঠাৎ ট্রাকের ধাক্কা
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের পাশের শহর বুউচনের এক ব্যস্ত খোলা বাজারে ১৩ নভেম্বর ২০২৫ একটি ডেলিভারি ট্রাক ঢুকে পড়লে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত ও অন্তত ১৮ জন আহত হন। দুপুরের একটু আগে, যখন সরু গলির এই বাজারটিতে ক্রেতা, ফেরিওয়ালা আর ডেলিভারি কর্মীদের ভিড় ছিল, ঠিক তখনই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ট্রাকটি প্রথমে ঢালু পথ ধরে প্রায় ২৮ মিটার পেছনে গড়িয়ে যায়, এরপর হঠাৎ সামনের দিকে জোরে ছুটে গিয়ে সবজি ও ফলের স্টল, প্লাস্টিকের টেবিল আর নিচু টিনের ছাউনি ভেঙে ফেলে। কিছুক্ষণের মধ্যে চিৎকার, উল্টে পড়া ঠেলাগাড়ি আর ছড়ানো তাজা সবজিতে পরিচিত বাজারপাড়া একটি আতঙ্কের দৃশ্যে পরিণত হয়।
স্থানীয় জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ জানায়, নিহত ও আহতদের বেশির ভাগই ছিলেন মধ্যবয়সী কিংবা বয়স্ক ক্রেতা, যাদের কাছে শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানোর মতো জায়গা ছিল না। কয়েকজনের মাথায় ও শরীরে মারাত্মক আঘাত লাগায় তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানানো হয়েছে, অন্যরা কেটে যাওয়া, আঘাত পাওয়া আর ধাক্কায় পড়ে যাওয়ার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অগ্নিনির্বাপক ও উদ্ধারকর্মীরা সরু গলির ভেতর স্ট্রেচার আর হুইলচেয়ারে করে আহতদের বের করে আনতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, কারণ একই সংকীর্ণ পথে তাঁদেরই ঢুকতে হয়েছে। পরে দোকানদারদের কেউ কেউ রক্তের দাগ লেগে থাকা এপ্রোন গায়ে দাঁড়িয়ে ভাঙা স্টল আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মালপত্তর দেখে呃 বোঝার চেষ্টা করছিলেন, কীভাবে স্বাভাবিক কেনাকাটার দিন কয়েক সেকেন্ডে এমন ভয়াবহতায় বদলে গেল।
প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে, ষাটোর্ধ্ব ট্রাকচালক হয়তো ঢালু রাস্তার ওপর গাড়ি রাখার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ বলছেন, যানটির ব্রেক কাজ করেনি, কেউ বলছেন চালক পার্ক করার সময় সঠিকভাবে গিয়ার পরিবর্তন করতে পারেননি; আবার আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে, চালক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ ঘটনাস্থলেই চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অ্যালকোহল টেস্ট করেছে এবং পুরোপুরি প্রযুক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ট্রাকটিকে জব্দ করেছে। দুর্ঘটনার আগে ও পরে ঠিক কতক্ষণে কত দূর ট্রাকটি গড়িয়েছে—তার পূর্ণ পুনর্গঠন করে ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বাজারটি গড়ে উঠেছে অনেক পুরোনো নগর কাঠামোর ভেতরে, যেখানে ঢালু পথ, বাঁকানো গলি আর পাকা ফুটপাত প্রায় নেই বললেই চলে। পণ্য ওঠানামার ছোট ট্রাক, ভ্যান আর ডেলিভারি ভ্যান একই গলিতে মানুষের হাঁটা-চলার সঙ্গে মিশে যায়, আর ফাঁকা পেলেই কেউ যেন সেখানে গাড়ি থামিয়ে দেয়—এটাই দৈনন্দিন বাস্তবতা। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বহুদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, এমন মিশ্র ব্যবহারের জায়গাগুলোতে সামান্য একটুও ভুল বা যান্ত্রিক ত্রুটি বড় দুর্ঘটনায় গড়াতে সময় নেয় না। বুউচনের ঘটনাটি এখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, পরিচিত মধ্যবিত্ত এলাকার বাজারও কেমন করে কয়েক সেকেন্ডে উচ্চ-ঝুঁকির জায়গায় পরিণত হতে পারে।
নগরবাসীর ক্ষোভ আর আতঙ্ক
দুর্ঘটনার পরদিন থেকে বাজারের প্রবেশমুখে নিহতদের স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা ফুল, মোমবাতি আর হাতে লেখা বার্তা রেখে শোক প্রকাশ করছেন। সাময়িকভাবে সেখানে বড় যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং গলির শুরুতে লোহার ব্যারিকেড বসানো হয়েছে, যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হয়। একই সঙ্গে শহর কর্তৃপক্ষ বুউচনের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী বাজারের গলি, ঢালু রাস্তা ও যান চলাচলের ধরন যাচাই করে সম্ভাব্য ঝুঁকি খুঁজে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। তা থেকে স্পষ্ট—সমস্যাটি শুধু এক বাজারে সীমিত নয়, অনেক পুরোনো বাজার এলাকাই একই ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, ভিড়ের সময় বিশেষ করে দুপুরের দিকে বাজারের গলিতে ট্রাক ও বড় ভ্যানের প্রবেশ কঠোরভাবে সীমিত করতে হবে। তাঁদের প্রস্তাব—রাত বা ভোরবেলা নির্দিষ্ট ডেলিভারি উইন্ডো, বাজারের বাইরে আলাদা লোডিং-জোন তৈরি, আর গলির মুখে শক্ত পিলার বসিয়ে দেওয়া, যাতে নিয়ন্ত্রণহীন কোনো গাড়ি ভিতরে ঢুকতে না পারে। বৃদ্ধ চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও দক্ষতা মূল্যায়ন আরও ঘন ঘন করার কথাও উঠেছে, কারণ অনেক উন্নত দেশে দ্রুত বয়স বাড়ছে কর্মশক্তির। আবার কারও মতে, কেবল চালককে দায়ী করে লাভ নেই; যদি রাস্তার ঢাল, ব্রেকের ত্রুটি আর নগর নকশার সীমাবদ্ধতা ঠিক না হয়, তবে একই ধরনের দুর্ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।

বাংলাদেশি পাঠকদের জন্য এই দৃশ্য খুব অপরিচিত নয়। ঢাকার পুরোনো অংশ কিংবা জেলা শহরগুলোর হাট-বাজারেও সরু গলি, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান, মোটরসাইকেল, পিকআপ আর মাঝেমধ্যে ট্রাক একই জায়গা ভাগ করে নেয়। মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে আইন ও সচেতনতার কিছু অগ্রগতি হলেও, স্কুলের সামনে, হাটবাজার ও গলিপথে হাঁটা-চলার নিরাপত্তা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। বুউচনের ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে, বাজারের আশপাশে ভারী যানবাহনের গতি ও প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, স্পষ্ট আলাদা হাঁটার পথ এবং জরুরি অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশের পথ নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন আর বিলম্ব করার মতো নয়।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বাজারের উন্নয়ন মানেই পুরোনো চরিত্র বা ছোট ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দেওয়া নয়। অপেক্ষাকৃত কম খরচে একমুখী যানচলাচল ব্যবস্থা, কোমর-উচ্চতা ব্যারিকেড, বাজারের প্রবেশমুখে স্পিডব্রেকার, গলির এক পাশে নির্দিষ্ট লোডিং জোন এবং বিকল্প ফায়ার সার্ভিস রুট তৈরি করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। তাঁদের মতে, বুউচনের এই দুর্ঘটনা শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য নয়, এমন সব শহরের জন্য সতর্কবার্তা যেগুলোতে দ্রুত নগরায়নের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী হাটবাজার আর ভারী যানবাহন একই জায়গায় ঠাসাঠাসি হয়ে আছে। এখন প্রশ্ন শুধু, এই ঘটনাকে শিক্ষা হিসেবে নিয়ে কে আগে বাস্তবে পরিবর্তন আনে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















