ধুলা–ধোঁয়া আর শ্বাসকষ্টের স্থায়ী সহবাস
শুক্রবার সকালে অনেকে ভাবেন, আজ হয়তো একটু নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি করা যাবে—অফিস নেই, যানজট থাকবে কম। কিন্তু জানালা খুলতেই চোখে পড়ে ধোঁয়াটে আকাশ, মোবাইলের স্ক্রিনে লাল রঙের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স। ছুটির দিনেও ঢাকা থাকে বিশ্বের দূষিত শহরের শীর্ষে; বাতাসে এমন সূক্ষ্ম ধুলা আর ধোঁয়া মিশে থাকে যে সামান্য হাঁটাহাঁটিতেই গলা খুসখুস, চোখ জ্বালা আর বুক ভারী লাগা যেন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশ–সংশ্লিষ্টদের মতে, এই পরিস্থিতি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং নগর উন্নয়নের এক অসম চিত্র। বর্ষা শেষে শহরজুড়ে যে অসংখ্য নির্মাণকাজ চলে, তার বেশিরভাগ স্থানে বালু–ইট ঢেকে রাখার নিয়ম মানা হয় না। কাঁচা রাস্তা, ভাঙা ফুটপাত ও খোলা মাটি থেকে উঠে আসা ধুলার সঙ্গে যোগ হয় পুরোনো ইঞ্জিনচালিত বাস–মিনিবাসের কালো ধোঁয়া। অনেক জায়গায় আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলা হয় রাস্তার পাশে, এতে বায়ুতে মিশে যায় বিষাক্ত গ্যাস। ফলে ট্রাফিক কম হলেও বাতাসে দূষণের ঘনত্ব থাকে বিপজ্জনক পর্যায়ে।
চিকিৎসকেরা বারবার সতর্ক করলেও অনেকেই অভ্যাসের জোরে এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু অতি সূক্ষ্ম ধুলা কণিকা ফুসফুসের গভীরে গিয়ে জ্বালা–পোড়া সৃষ্টি করে; দীর্ঘমেয়াদে এটি হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, এমনকি হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ক্ষতি আরও বেশি; সামান্য ধূলোমাখা হাঁটাহাঁটিতেই তাদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, অনেক সময় জরুরি হাসপাতালে নিতে হয়। ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়া মানে স্কুল–কলেজ, অফিস–ব্যবসায়ও অনিশ্চয়তা।

নাগরিকেরা নিজেদের মতো করে প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। কেউ মাস্ককে প্রতিদিনের সঙ্গী করেছেন, কেউ আবার প্রতিদিন সকালে AQI দেখে বের হন। বাচ্চাদের খেলাধুলার সময় এখন অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বেলা বা বিকেলের নির্দিষ্ট ঘন্টা। প্রধান সড়ক বা ফ্লাইওভারের কাছাকাছি বাসায় থাকেন যারা, তারা জানালা–দরজা খোলার সময় নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। তবু যাদের জীবিকা রাস্তায়—রিকশাচালক, হকার বা ট্রাফিক পুলিশ—তাদের পক্ষে পালানোর পথ প্রায় নেই; দীর্ঘ সময় দূষিত বাতাসে থাকার ফলে শরীরে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব অনেক সময় কারওই জানা থাকে না।
ব্যক্তিগত সতর্কতার পাশাপাশি কাঠামোগত উদ্যোগের ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। কোনো কোনো সময়ে অভিযান চালিয়ে ঢাকায় পুরোনো যানবাহন বা নির্মাণসাইটের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয় বটে, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হয় না। নিয়ম অনুযায়ী রাস্তা ধোয়া, বালু–ইট ঢেকে রাখা, আবর্জনা না পুড়িয়ে সঠিকভাবে অপসারণ—এসব পদক্ষেপ ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন আসে না। ফলে দায় শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে মানুষের ফুসফুসের ওপরেই।
অর্থনীতিতেও এর প্রভাব কম নয়। অসুস্থতার কারণে কর্মঘণ্টা হারানো, চিকিৎসা ব্যয় বাড়া, শিক্ষার্থীদের ক্লাস মিস করা—সব মিলিয়ে শহরের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কমে। পর্যটক বা বিদেশি বিনিয়োগকারীর চোখে দূষিত শহর একটি বড় নেতিবাচক বার্তা পাঠায়। যারা দিনভর রাস্তায় কাজ করেন, তাদের জন্য প্রতিটি “বিষাক্ত” দিনই আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ ডিউটি, যেখানে মজুরির সঙ্গে যোগ হয় অদৃশ্য স্বাস্থ্য–খরচ।
তবু ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, দূষণ বেশি থাকলে অপ্রয়োজনীয় বাইরে থাকা এড়িয়ে চলতে, ব্যস্ত সড়কে চলাফেরার সময় মানসম্মত মাস্ক ব্যবহার করতে, ঘরের ভেতর ধূমপান বন্ধ রাখতে এবং তুলনামূলক পরিষ্কার সময়—যেমন ভোর বা গভীর রাতে—ঘর বাতাস চলাচলের সুযোগ করে দিতে। একই সঙ্গে গণপরিবহন উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নির্মাণকাজ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি জনদাবি গড়ে তোলাও জরুরি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















