জ্বালানি নিরাপত্তা ও জলবায়ু প্রতিশ্রুতির দ্বন্দ্ব
উত্তর আমেরিকার জ্বালানি মানচিত্রে আবার বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে পাইপলাইন অপারেটর এনারব্রিজের সর্বশেষ ঘোষণা। কোম্পানিটি প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নিজেদের বিদ্যমান নেটওয়ার্কের অংশবিশেষ উন্নত করে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রিফাইনারিগুলোতে আরও বেশি অপরিশোধিত তেল পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। নতুন করে সম্পূর্ণ পাইপলাইন নির্মাণের বদলে পুরোনো রুটকে আধুনিক করার এই কৌশল অনুমোদন প্রক্রিয়া তুলনামূলক দ্রুত করার হিসাবেও দেখা হচ্ছে। কানাডীয় তেল উৎপাদকদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রপ্তানি ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে গেলে তাদের অনেক সময় কম দামে তেল বিক্রি করতে হয়।
অন্যদিকে, মার্কিন মধ্যপশ্চিম ও গালফ অঞ্চলের রিফাইনারিগুলোর জন্য স্থিতিশীল সরবরাহ মানে বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামার ধাক্কা কিছুটা সামলানো সম্ভব। তবে এমন এক সময়েই এই প্রকল্প এগোচ্ছে, যখন দুই দেশই জলবায়ু প্রতিশ্রুতি পালন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, দীর্ঘমেয়াদি ফসিল জ্বালানি অবকাঠামোতে নতুন বিনিয়োগ মূলত ভবিষ্যতের কার্বন নির্গমন “লক–ইন” করে দিচ্ছে। তারা অতীতের লিক, আদিবাসী জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং সংবেদনশীল জলাভূমি নিয়ে নজির টেনে কঠোর পরিবেশ–সমীক্ষার দাবি তুলছে।
বিনিয়োগের সংকেত, জলবায়ু নীতি আর আঞ্চলিক রাজনীতি
এনারব্রিজের যুক্তি হলো, বিদ্যমান পাইপলাইন উন্নত করা বিকল্পের তুলনায় নিরাপদ—বিশেষ করে যদি বিকল্প হয় পুরোনো অবকাঠামো বা রেল–ট্যাঙ্কার ট্রেনে বিপুল পরিমাণ তেল পরিবহন। কোম্পানি আরও বলছে, উত্তর আমেরিকায় তেলের চাহিদা কিছু বিশ্লেষকের পূর্বাভাসের মতো দ্রুত কমছে না; বিশেষ করে বিমান জ্বালানি ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতে বৃদ্ধি বজায় আছে। ফলে হঠাৎ করে সরবরাহ বন্ধ না করে ধীরে ধীরে রূপান্তরের পথই বাস্তবসম্মত।
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য এখন বড় হিসাব—স্বল্পমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা এবং দীর্ঘমেয়াদি নিট–শূন্য লক্ষ্যকে কীভাবে একসঙ্গে দেখা হবে। সমর্থকদের দাবি, নিজস্ব ও প্রতিবেশী দেশের তেল ব্যবহার করলে যুদ্ধ, নৌ পরিবহনে ঝুঁকি কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হঠাৎ শিপমেন্ট বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। সমালোচকদের পাল্টা যুক্তি—এ ধরনের প্রকল্প বৈদ্যুতীকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি ও নিম্ন–কার্বন জ্বালানির দিকে ঢালাও বিনিয়োগকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে বিনিয়োগকারীরাও দেখছেন—মাঝ–২০২০ দশকে বড় তেল পাইপলাইন প্রকল্পে বাজারের আসল ক্ষুধা কতটা। কিছু পেনশন ফান্ড ও ব্যাংক নিজেদের জলবায়ু নীতি কঠোর করলেও, অনেকেই এখনও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি–নির্ভর পাইপলাইনকে তুলনামূলক স্থিতিশীল, বন্ডের মতো সম্পদ হিসেবে দেখেন। কানাডার জন্য এই প্রকল্প মনে করিয়ে দিচ্ছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি আর কার্বন ট্যাক্স বাড়লেও অর্থনীতিতে তেল–গ্যাসের গুরুত্ব কতটা শক্ত। আর যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সামনে আবার সেই পুরোনো প্রশ্ন—জ্বালানির দাম সামলে রাখতে তারা কতটা দূর পর্যন্ত এই ধরনের সীমান্ত–পার অবকাঠামোর ওপর ভরসা করবেন, এবং দশ বছর পর জলবায়ু হিসাব কষতে গিয়ে এই সিদ্ধান্তগুলো কেমন দেখাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















